হাইস্কুল, বন্ধুত্ব: জীবনের মধুর সব স্মৃতি

একটিবার হাইস্কুলে ফেরা যাক। টাইম মেশিনে চড়ে আপনার হাইস্কুলের দিনে ফেরা যায়? ফেরা যায় সেই ক্লাস সিক্স বা সেভেনে পড়া বয়সে? যদি স্মৃতির পাতা উল্টে ফিরে যেতে পারেন হাইস্কুলের দিনে, তবে দেখবেন সাদা শার্ট-প্যান্ট, এক জোড়া সাদা কেডস, চুলে সিঁথি করে স্কুলে যাওয়া কাউকে। মনে হবে, জীবনের একমাত্র লক্ষ্যই বুঝি স্কুলে যাওয়া আর সীমাহীন আনন্দ পাওয়া। গল্পভেদে কারও স্কুলের ড্রেসের রং ভিন্ন হতে পারে, তবে হাইস্কুলে পাওয়া ওই অপার্থিব সুখস্মৃতি একই।

স্কুলের বিল্ডিং পেরিয়ে বিশাল মাঠ, কেউ কেউ হয়তো পাশে পেয়েছেন বড় পুকুরও। জীবনে তখন শুধু গণিত বইয়ে মাথা গুঁজে পাটিগণিত আর বীজগণিতের হিসাব চুকানো ছাড়াও অন্য এক উদ্দেশ্য ছিল। সে উদ্দেশ্যও আনন্দের। কখন টিফিন পিরিয়ড কিংবা ছুটির ঘণ্টার সেই মধুর শব্দ বাজবে আর আপনি আপনার বন্ধুদের নিয়ে নেমে পড়বেন স্কুলের বিশাল মাঠটায়। সে এক আনন্দ ছিল বটে। কখনো ক্রিকেট, কখনো ফুটবল। একই ক্লাসের অন্য শাখার বন্ধুদের সঙ্গে কিংবা সিনিয়র বা জুনিয়রদের সঙ্গে ম্যাচ খেলা। সেসব খেলার উত্তেজনা আর মাঠের ওই লড়াকু মনোভাবে যেন ইংল্যান্ড–অস্ট্রেলিয়ার অ্যাশেজ দ্বৈরথ বা এল ক্ল্যাসিকোর রিয়াল–বার্সা ম্যাচ ফিরিয়ে আনতে পারত! এমনই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল সেসব ম্যাচ।

শুধু কী ক্রিকেট বা ফুটবল! সবকিছুতেই অন্য রকম মজা ছিল ওই পাঁচ বছরের জীবনে। বন্ধুদের দেওয়া কোনো এক নামে তখন আপনার সার্টিফিকেটের নাম ভুলে যাওয়ার জোগাড়। বন্ধুরা যে নামে ডাকে, সেটিই আপনার নাম হয়ে যায় পাঁচ বছরের জন্য কিংবা বন্ধুদের কাছে আপনি সে নামেই থেকে যান বাকিটা জীবন।

টিফিন পিরিয়ডে টিফিন নিয়ে কাড়াকাড়ি, গণিতের কোনো কঠিন সমাধান বন্ধুদের কাছ থেকে খুব সহজে বোঝা কিংবা কখনো কোনো পরীক্ষায় নম্বর কম পেলে আবার তাদের কাছ থেকেই সহমর্মিতা পাওয়া। সে বন্ধুরাই আপনার বিপদে পাশে থেকেছে বারবার। হাইস্কুল শেষে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাতে বসলে সীমাহীন আনন্দের সঙ্গে বেশ কয়েকজন ভালো বন্ধুও পেতে পারেন। পেয়েছেন নিশ্চয়?

হাইস্কুল নিয়ে কথার মধ্যে আমার হাইস্কুলের নামটা যোগ করার লোভ সামলাতে পারলাম না! আমার হাইস্কুলের নাম ছিল—ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। ছোট্ট জেলা ফেনীর শহরটাও খুব ছোট, ৩০ মিনিট বা তার চেয়ে একটু বেশি সময় নিয়ে রিকশায় ভ্রমণ করলে আপনার প্রায় পুরো শহর ঘোরা হয়ে যাবে। শহরের প্রাণকেন্দ্রেই স্কুলের অবস্থান। উপরোক্ত বর্ণনার মতোই স্কুলের বিশাল মাঠ, পাশে রয়েছে পুকুর। স্কুলের শোভাবর্ধক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৩০ বছরের অধিক পুরোনো লাল বিল্ডিং।

‘খেতে দিলে শুতে চায়’, সেই পুরোনো প্রবাদ সত্যি করে স্কুলের নামের পরে এবার বন্ধুদের নামেও কিছু বলা যাক। যেহেতু স্কুলের নাম এসেই গেছে, ওদের নামে কিছু না বললে আবার আমায় শাসাতেও পারে! কেউ হয়তো বলেও বসতে পারে, ‘কী রে, আমাদের নিয়ে কিছু নেই কেন?’ সেই দায় এড়ানোর চেষ্টা করা যাক।

আমরা বন্ধুরা মিলে স্কুল মাঠে প্রচুর খেলাধুলা করতাম। ক্লাস এইটে থাকতে কারও একজনের মাথা থেকে আসে, আমাদের ক্রিকেট আর ফুটবল দলের নাম দেওয়া উচিত। পরে ক্লাসের সঙ্গে মিলিয়ে নামকরণ হয়, ‘এইট স্টার’; পরে ক্লাস বাড়ার সঙ্গে ‘এইট স্টার’ থেকে ‘নাইন স্টার’, তারপর শেষ ‘টেন স্টার’ নামে। হাইস্কুল জীবনের পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো একসঙ্গে কোথাও খেলতে নামলে দলের নাম থাকে ‘টেন স্টার’। ওদের সঙ্গে দলবেঁধে আড্ডা, পাবলিক লাইব্রেরিতে যাওয়া, খেলা শেষে পুকুরে নামা—সবই জীবন ক্যানভাসে সুখ নামের রংচটা হয়ে থাকবে। ওই বন্ধুরাই শিখিয়ে গেছে ভ্রাতৃত্ববোধ আর বিনয়ী হওয়া। হাইস্কুলে পড়ালেখা শেখার পাশাপাশি সেটাও এক প্রাপ্তি।

কোনো ব্যস্ততম দিনে, কোনো অলস দুপুরে, কোনো বিষণ্ন বিকেলে হুট করে ভাইদের মিস করা যায়। বন্ধুদের ‘ভাই’ বলছি কেন? পৃথিবীজুড়ে প্রিয় বন্ধুদের ভাই বলে ডাকার চর্চা হয়। আপনিও নিশ্চয় ডাকেন। তাই নয়?

*শিক্ষার্থী