চায়ের রাজ্যে একা একা ঘোরা

চা–বাগানের অফিস। ছবি: লেখক
চা–বাগানের অফিস। ছবি: লেখক

স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আগে প্রায়ই ট্যুর দেওয়া হতো। তবে এখনো যে কোথাও যাওয়া হয় না সেটাও ভুল বলা হবে। আগে তাদের সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে ট্যুরের রুটিন করা হতো আর সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু দুই ঈদের ছুটিতে। কিন্তু আমার তো পাগল মন, ট্যুর ছাড়া প্রতি সপ্তাহে কোনোভাবেই ভালো লাগে না। স্কুলের বন্ধুরা এখন সময় দিতে না পারলেও আমি তো আর প্রকৃতিদর্শন বন্ধ রাখতে পারি না। স্কুলের বন্ধুরা এখন সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত হওয়াতে সঙ্গী হিসেবে নিজেকেই নিজে বেছে নিতে আমার একটুও কার্পণ্য হয়নি।

গত বছরের নভেম্বরে আমি আমার আমিকে সঙ্গে নিয়ে প্ল্যান করি চায়ের দেশ দার্জিলিং যাব। ভারতে এমবিএ করাতে আমার দার্জিলিং ট্যুরের জন্য কোনো ঝামেলাই পোহাতে হয়নি। প্রথমে অফিস থেকে ৫ দিনের ছুটি ম্যানেজ করে সোজা চলে যাই নিজ জেলা নীলফামারী। আমাদের ওখান থেকে আবার চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত খুবই কাছে। ঘণ্টা দু–এক সময় লাগে।

দার্জিলিং যাওয়ার আগে আমি কখনই এ বর্ডার দিয়ে ভারতে যাইনি। এরপরও সব নতুনের স্বাদ নিতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। আর সেটা যদি একা একা নিই, তাহলে তো সেটার তৃপ্তি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

পাহাড়ের কোলে রাস্তা। পুরো এমন সুন্দর। ছবি: লেখক
পাহাড়ের কোলে রাস্তা। পুরো এমন সুন্দর। ছবি: লেখক

নীলফামারীর সৈয়দপুর থেকে প্রথমে বাসে করে এলাম রংপুরে। সেখান থেকে অটোতে করে চলে আসি লালমনিরহাটের কাকিনা রেলস্টেশনে। বেলা দেড়টার দিকে এসে স্টেশনমাস্টারকে জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বলেন ১০ মিনিটের মধ্যেই ট্রেন আসবে। ছেড়ে যাবে বুড়িমারী স্টেশনের উদ্দেশে। মনে মনে আলহামদুলিল্লাহ বলে মহান আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানালাম। কারণ, বুড়িমারী যাওয়ার ট্রেনের সিডিউল আমার জানা ছিল না। ট্রেন যথাসময়ে আসার পর আমি ট্রেন পরিচালককে অনুরোধ করে তার রুমে বসে পড়লাম। এরপর বিকেল চারটার মধ্যে আমি পৌঁছে যাই বর্ডারের কাছে। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে বিকেল সাড়ে চারটার মধ্যে আমি ভারতে প্রবেশ করি।

ছবির শুটিং হওয়া সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছবি: লেখক
ছবির শুটিং হওয়া সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ছবি: লেখক

আমার আবার খুব সাধারণভাবে যাতায়াত করতে খুবই ভালো লাগে। তাই হয়তো রিজার্ভ করা আমার খুবই বিরক্ত লাগে। একা মানুষ এতো অর্থ অপচয় করে রিজার্ভ করাটা আমার জন্য বড্ড বেমানান। তাই সন্ধ্যা অবধি বর্ডারেই অপেক্ষা করলাম। বাইক শেয়ার পাওয়া যায় এখান থেকে। ২০ রুপি করে নেয় শিলিগুড়ি যাওয়ার বাস ধরিয়ে দেয়। যাত্রাপথে মোটরসাইকেলে চালকের সঙ্গে এমন আড্ডা জমে গেল। আর গল্প আড্ডার কারণে তিনি আমাকে নামিয়ে দিলেন একটা পয়সাও নিলেন না। বরং আমার শিলিগুড়ি যাওয়ার খরচটাও তিনি দিয়ে দিয়েছে।

রাত আটটার দিকে নেমে হোটেল ঠিক করেই কোনোমতে কাঁধের ব্যাগটা রেখে ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ি রাতের শিলিগুড়ির সৌন্দর্য উপলব্ধি করার জন্য। অসম্ভব সুন্দর নিস্তব্ধ শিলিগুড়ি। রাত ১১টা পর্যন্ত বাইরে বাইরেই ঘুরি। শীতের রাতে তখন সেখানে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এমন রাতে শীতের কাপড় ছাড়া ঘুরতে কেমন লেগেছে সেটা ভাষায় অপ্রকাশ্য।

দার্জিলিং শহর। ছবি: লেখক
দার্জিলিং শহর। ছবি: লেখক

পরদিন খুব সকালে বেরিয়ে পড়ি দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে। শেয়ার জিপে ১৫০ রুপি ভাড়া দিয়ে রওনা দিই দার্জিলিংয়ে। দুপুর হতে না হতেই আমি পৌঁছে যাই আমার গন্তব্যে। চায়ের দেশে আসার পথেই বুঝেছি কতটা অপরূপ দার্জিলিং। এতটা সুন্দর প্রকৃতি হতে পারে? তবে আমার পড়াশোনা যেহেতু ভারতের শিমলায় ছিল, তাই দার্জিলিংয়ে যাওয়ার সময় অনেকবারই শিমলার কথা মনে হয়েছে। সেই পাহাড়ি রাস্তা, পাহাড়ি মানুষদের খেটে খাওয়া জীবন, আঁকাবাঁকা রাস্তা, প্রকৃতির নিস্তব্ধতা, সারল্যভরা প্রতিটি জীবন।

সেদিন দার্জিলিংটা পুরোটা বিকেল, রাত ধরে ঘুরেছি হেঁটে হেঁটে। পাহাড়ি রাস্তায় আমার হাঁটতে ভীষণ ভালো লাগে। শিমলায় এমবিএ লাইফে প্রায় প্রতিদিনই নির্জন রাতে আমি আর আমার বন্ধু মিলে হাঁটতাম। সে ফ্লেভারটা নেওয়ার জন্যই আমি নির্জন দার্জিলিং রাতভর হেঁটেছি।

চা–বাগানে লেখক। ছবি: লেখক
চা–বাগানে লেখক। ছবি: লেখক

সমস্যা হয় পরদিন দার্জিলিং সাইট সিয়িংয়ের সময়। আমি একা গেলেও যে খরচ, ৭–৮ জন গেলেও জিপে একই খরচ। চিন্তায় পড়ে যাই তখন। কী করা যায়, কী করা যায়? শেষে লোকালভাবে একটা বাসে করে সেন্ট জোসেফ কলেজে যাই। যেখানে শাহরুখ খান, সুনীল শেঠীর ‘ম্যা হু না’ সিনেমা, ‘আরিয়ান’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল। একটা ইচ্ছা সেটা পূরণ হয়েছে। কিন্তু পায়ে হেঁটে সারা দার্জিলিং তো আর শেষ করা যাবে না। চিন্তা করতে করতে একটা স্থানীয় গ্রামের ভেতর চলে যাই। সেখানেই আমার সমবয়সী এক ছেলে আমাকে ডেকে বলে আমি কোথায় যাব। পরে তার বাইকে করেই দুই দিন দার্জিলিংয়ের আনাচকানাচে ঘোরায়।

লেখক। ছবি: সংগৃহীত
লেখক। ছবি: সংগৃহীত

যেসব জায়গায় কোনো পর্যটকই কোনো দিন যেতে পারবে না, সেসব জায়গায় আমরা ঘুরেছি। শুভম আমার সমবয়সী হওয়াতে আমার জন্য ওর সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হতে একটুও সময় লাগেনি। বরং দার্জিলিংয়ে ওর যত বন্ধু আছে, সব এখন আমারও বন্ধু।

এমন সুখস্মৃতি নিয়ে আবারও দেশে ফিরেছি, যা বহু বছর ধরে বয়ে বেড়াতে পারব। তবে এটা খুব উপলব্ধি করি, এখন যদি আমার ডাকে কেউ না সাড়া দেয়, তাহলে একলা চলাটাই শ্রেয়। পথিমধ্যে অনেক অনেক নতুনত্বের জন্ম হয় এই সময়ে।

*বিএসসি ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার, এমবিএ ইন মার্কেটিং, ভারত