জলবায়ু পরিবর্তনরোধে তারুণ্যের ভূমিকা

জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখতে হবে তরুণদের। ছবি: সংগৃহীত
জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে ভূমিকা রাখতে হবে তরুণদের। ছবি: সংগৃহীত

জলবায়ু পরিবর্তন রোধে ঘুমন্ত ও উদাসীন বিশ্বনেতাদের জেগে ওঠার সময় আর বেশি অবশিষ্ট নেই। সবাইকে জেগে উঠে দায়িত্ব নিয়ে পৃথিবীকে বাঁচাতে প্রাণপণে ঝাঁপিয়ে পড়ার এখনই সময়। তা না হলে পৃথিবী ও পৃথিবীর মানুষ জলবায়ু সংকটের মুখে ধুঁকতে ধুঁকতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। আর এর দায় নিতে হবে বিশ্বনেতাদের। কেননা, ইতিপূর্বে সমগ্র বিশ্বের তরুণ সমাজ বিশ্বনেতাদের এই বিষয়ে দায়িত্বজ্ঞানহীনতা লক্ষ করতে পেরেছে। বিশ্বনেতারা জেগে উঠলে তরুণেরা সাহস পাবে, অনুপ্রেরণা পাবে।

তরুণেরা এখন সচেতন। জলবায়ু পরিবর্তন রোধে নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি সবুজ-শান্ত-শীতল বিশ্ব প্রত্যাশা করে তরুণ সমাজ। আগামীর পৃথিবী তারুণ্যের। তাই মনে করি, আমাদের এ বিষয় সোচ্চার হতে হবে।


জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্বে যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে, তা নদীমাতৃক এই দেশের জন্যও আশঙ্কাজনক। যা আমরা অনেকে বুঝতেই পারি না। এমনকি অনেকে জলবায়ু পরিবর্তন অর্থটাও বুঝতে সমর্থ হই না অনেক সময়। যদিও সবকিছু বুঝতেই হবে এমনটা আমি বলছি না। আমরা তরুণ। ধীরে ধীরে বুঝে নেব। আর নিজেদের প্রয়োজনকে টিকিয়ে রাখতে সংগ্রাম করব।


এখন আমরা ধরতে পারছি যে, অনেক স্থানে বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাচ্ছে। সমুদ্র উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। আর এতে করে বাড়ছে সিডর, আইলা, আম্পান, নিসর্গ ইত্যাদির মতো বড় বড় প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়। অপরদিকে মানুষ নিজেরাই ধ্বংস করছে বনজঙ্গল, হত্যা করছে প্রাণী-কীটপতঙ্গ। পৃথিবীর ফুসফুস নামে পরিচিত আমাজনে প্রতিদিনই জ্বলছে আগুন, পুড়ছে প্রাণী-উদ্ভিদ। ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের উদ্ভিদ কেটে উজাড় করা হয়েছে। হাতে ধরেই আমরা আমাদের প্রহরীকে হত্যা করতে চাই। অথচ এই সুন্দরবনই বুক চিতিয়ে আমাদের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দেয় বারবার।


জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি হুমকিতে আছে বলতে হবে দেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজার। এই জেলার সিংহভাগ এলাকা উপকূলবাসী। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে, লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে কক্সবাজার শহরের সমিতিপাড়া, ডায়াবেটিক পয়েন্ট (বর্তমানে শাহীন বিচ পয়েন্ট), শৈবাল পয়েন্টসহ গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন পয়েন্ট। এই কারণে কক্সবাজারের মানুষ আর কয়েক বছর পরে গৃহহীন হয়ে ভাসমান জীবন যাপনও করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুধু বাড়িই নয়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে মানুষ দিন দিন হারাতে বসেছে ফসলের মাঠসহ তাদের শ্রম দেওয়া বিভিন্ন কাজের জায়গাও!

মূলত আমরা দেখছি, একদিকে প্রকৃতিতে উষ্ণতা বাড়ছে। অন্যদিকে সেই উষ্ণতাকে শতগুণ বাড়িয়ে তুলছি আমরা সভ্য সমাজ। জীবাশ্ম জ্বালানির অতি ব্যবহারের ফলে গত কয়েক দশক প্রকৃতি পুড়তে পুড়তে উত্তপ্ত হয়েছে, জ্বলে-পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। প্রকৃতি আর কত সহ্য করবে? এবার ফুঁসে উঠেছে। ফিডব্যাক এল—করোনার মতো মহামারি। মানুষ জেনেবুঝে এভাবে প্রকৃতি ধ্বংস পাঁয়তারা করার ফলে প্রকৃতিও আমাদের ধ্বংস করার মিশন নিয়েছে হয়তো। করোনা একটা উদাহরণ। ভবিষ্যতে করোনার চেয়ে আত্মঘাতী ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে ভাইরোলজিস্টরা সতর্ক করেছেন, যদি আমরা প্রকৃতির প্রতি সুবিচার করতে না পারি।

কথা হলো, এই দুঃসময়ে আমাদের কী করতে হবে? হ্যাঁ, আমাদের করণীয় আমাদেরই ঠিক করতে হবে। আমাদের পৃথিবীকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে। এই ক্ষেত্রে আমরা যারা তরুণ তাদেরই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে সবাইকে বাঁচাতে হবে।

এর জন্য প্রথমেই আমাদের সবুজায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। বেশি বেশি বৃক্ষ রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে তারুণ্যের মনকে সবুজ-সতেজ করতে হবে, যাকে বলতে পারি—মনের সবুজায়ন। এরপর মাঠে নামতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে।

সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি
সুন্দরবন। প্রথম আলো ফাইল ছবি

বাংলাদেশে প্রায় অনেকাংশ জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মুখে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এর থেকে গুরুত্বপূর্ণ সময় এর আগে কখনো আসেনি।
অসংখ্য তরুণকে এই বিষয়ে সচেতনতামূলক লেখালেখিতে এগিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় মানুষদের সচেতন করতে হবে, যারা আসলে বোঝে না জলবায়ু পরিবর্তন কী জিনিস। তাদের তা বোঝাতে হবে। আর এই কাজ আমাদের হাতেই ন্যস্ত। সরকারের বা কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব আছে। কিন্তু তরুণদের এই ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে হবে।


তবে হ্যাঁ, সরকারি সহায়তা অবশ্যই লাগবে। তবেই তরুণেরা সাহস পাবে। এখনই সময় এই বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ নেওয়ার। এখন থেকে নানাবিদ উদ্যোগ বাস্তবায়ন ও বনজঙ্গল উজাড়ে বাধা ও সে ক্ষেত্রে কঠোর হওয়া গেলে জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করা অনেকটা সম্ভব হবে। তার জন্য আরও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সরকারকে। সময়মতো ও স্বচ্ছতার সঙ্গে তা চালিয়ে নিতে হবে।


জলবায়ু পরিবর্তনে যেহেতু সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী উপকূলীয় এলাকার বাসিন্দারা। তাই এ ক্ষেত্রে পলিসি ও কর্মকাণ্ডে তাদের প্রতিনিধি রাখতে হবে।


আমরা জানি, প্রকৃতি তার আপন গতিতে চলে এবং আমাদের প্রকৃতিকে প্রয়োজন আছে। প্রকৃতিকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সবার। আগামী দিনের উন্নয়নে প্রকৃতি ও সমাজকে রক্ষা করার যে অঙ্গীকার, তা বাস্তবায়ন করতে হবে। যদিও তা অনেক বিরাট চ্যালেঞ্জ। কিন্তু তরুণেরা সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণে প্রস্তুত।


* সমন্বয়কারী, ইয়ুথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস, কক্সবাজার।