আসছে 'নয়া স্বাভাবিক' পরিস্থিতি

নয়া স্বাভাবিক বাস্তবতা মেনে নিতে যত বিলম্ব হবে, তত ঝক্কি পোহাতে হবে। ছবি: রয়টার্স
নয়া স্বাভাবিক বাস্তবতা মেনে নিতে যত বিলম্ব হবে, তত ঝক্কি পোহাতে হবে। ছবি: রয়টার্স

এই করোনাকালে আমরা সবাই যে স্বাভাবিক জীবনের জন্য অপেক্ষা করছি, সেই জীবনটা কীভাবে স্বাভাবিক হবে? সেই স্বাভাবিকত্বের চেহারা আসলে কী, সেটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার।


আমরা ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, পানি ফ্রি, বাতাস ফ্রি। বাংলাদেশে পানি যখন প্রথম বোতলে ভরে বিক্রি শুরু হয়, সেটার বাজারজাতকরণের সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সেই সময়টা এমন ছিল যে তখন যদি হোটেল বা রেস্টুরেন্টে মানুষের কাছে পানির বিল চাওয়া হতো, মানুষ খেপে যেত। ‘কী দিনকাল পড়ল, পানি টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে, এটা কোনো কথা হলো!’ ভোক্তার দিক থেকে এ ধরনের অবাক প্রশ্ন চলে আসত হরহামেশাই।
পানি যে টাকা দিয়ে কিনে পান করতে হয়, এটা মানুষের ভাবনার মধ্যে ছিল না। কিন্তু আজকের দিনে এসে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে যে পথে-ঘাটে পানি কিনেই পান করতে হয়। বাড়ির বাইরে প্রতিনিয়ত বোতলজাত পানি কিনে পান করছে মানুষ। এখন কোনো রেস্টুরেন্টে যদি বলা হয় পানি ফ্রি, তবে ভোক্তা উল্টো ওই রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিনা মূল্যে পরিবেশিত পানির উৎস ও বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন করবে। শুধু রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রশ্ন নয়, বরং ভোক্তা নিজেও সংশয়ে পড়বে সম্ভাব্য পেটের পীড়া নিয়ে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি উল্টে গেছে, একসময় পানির মূল্য চাওয়ায় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিত আর এখন পানির মূল্য না নিলে মানুষ সংশয়ী হয়ে প্রশ্ন ছোড়ে।

পানির বিশুদ্ধতা নিয়ে ভাবনা ও পানি পানকে কেন্দ্র করে মানুষের যে অভ্যাসগত আচরণের পরিবর্তন, তা আমাদের ইঙ্গিত দেয় নতুন পরিস্থিতি কীভাবে মানুষের কাছে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। পৃথিবী সব সময় কোনো না কোনো পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যায়। এসব পরিবর্তন কখনো কখনো খুব ধীরগতিতে সম্পন্ন হয় বলে অনেকের চোখে ঠাহর হয় না। নতুন নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে নতুন বাস্তবতা মানুষের মধ্যে জায়গা করে নেয় নিত্যদিন। সে কারণে করোনা-পরবর্তী পৃথিবীতে যে নয়া স্বাভাবিকতা আসবে বা আসছে, সেটি আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থা নয়।


গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেও যে জীবন আমরা যাপন করেছি, সেই স্বাভাবিক জীবন হয়তো কোনো দিনই ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই। এ কথা হয়তো কোনো কোনো সংবেদনশীল হৃদয়ের মানুষের মনে কষ্টের জোগান দিতে পারে। সেই আগের মতো স্বাভাবিক না হওয়ার ভেতরে নতুন নতুন বিষয় কিছু যুক্ত হবে। সেখানে হয়তো দৈনন্দিন চলাফেরায় মানুষের মুখে থাকবে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস, দূরত্ব বজায় রেখে মানুষে মানুষে আলাপ ইত্যাদি। পড়াশোনায় থাকতে পারে অন ও অফলাইনের মিশেল। থাকবে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে মিটিং-বৈঠক। হাজার লোকের সমাবেশ হয়তো পল্টন বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে না-ও হতে পারে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে বেশি আমলে নিতে হবে।


আগামী দিনে যেসব শিক্ষার্থী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবে, তাদের প্রযুক্তিসংক্রান্ত জ্ঞান থাকবে আকাশচুম্বী। এর কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে, একদিকে তারা প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের সময়ে পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে, দ্বিতীয়ত এই মহামারির বাড়িবন্দী অবস্থা তাদের কাছে প্রযুক্তিকে অদ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে হাজির করছে। এই দুয়ের চাপে হোক বা মিশেলে হোক, কিশোর-তরুণ শিক্ষার্থীরা হয়ে উঠছে প্রযুক্তির সন্তান।

এই যে নয়া স্বাভাবিক অবস্থা, তাকে মেনে নেওয়ার জন্য পৃথিবীর মানুষকে প্রস্তুত হতে হবে। নয়া স্বাভাবিক বাস্তবতা মেনে নিতে যত বিলম্ব হবে, আমাদের তত ঝক্কি পোহাতে হবে। নয়া পরিস্থিতিকে যত বেশি মানিয়ে নেওয়া যায়, যত বেশি মেনে নেওয়া যায়, তত দ্রুততার সঙ্গে এই কোভিড-১৯ পরিস্থিতিকে মোকাবিলার প্রশ্নটি জড়িত। নয়া পরিস্থিতিতে পড়ে নয়া বাস্তবতাকে পৃথিবীতে নামিয়ে আনার আয়োজন দেশে দেশে শুরু হয়ে গেছে। আমরা কবে তাকে বরণ করতে পারছি, সেই তাগিদবোধ রোজ কড়া নাড়ছে দুয়ারে। সেই বিবেচনায় আমাদের পরবর্তী যে আন্দোলন, যে কার্যক্রম, সেখানে নয়া স্বাভাবিকতাকে (নিউ নরমাল সিচুয়েশন) স্বাগত জানাতেই হবে।