আমরা কি মানবিক

ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়াল, বর্গী এলো দেশে,

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দিবো কিসে?
পান ফুরালো চুন ফুরাল খাজনা দিবো কি?
আর কটা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি।

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

এ রকম অনেক ছড়া গেয়ে আমাদের দেশে মা-বাবা সন্তানদের ঘুম পাড়ান, আবার অনেক সন্তান ছড়া না শুনলে খেতে বা ঘুমাতে চায় না। মা-বাবা ভাবেন, আমাদের সন্তান বড় হয়ে অনেক নাম-ধাম ও খ্যাতি অর্জন করবে। কেউ হবে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কেউবা শিক্ষক, কেউ বা রাজনীতিবিদ, কেউবা আইনজীবী, ব্যবসায়ী। এ রকম অনেক কিছু চিন্তাভাবনা থেকে মা-বাবা ছোট সন্তানকে বড় করেন, লেখাপড়া শেখান। তাঁরা আরও ভাবেন, আমাদের সন্তান অনেক মানবিক গুণের অধিকারী হবে। তার চিত্ত অনেক প্রশস্ত হবে। কিন্তু করোনাভাইরাস আমাদের দেশের সেই মানবিক গুণাবলির অধিকারী ছেলেদের সত্যিকার অর্থে মানবিক গুণ পরীক্ষা করেছে। আসলে কোন সন্তান কতটুকু মানবিক!

আমাদের দেশের অনেক বেসরকারি ডাক্তার চিকিৎসা দিতে ভয় পান। আবার বেশ কিছু ডাক্তার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন, তার মধ্যে মুগদা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডাক্তার ও নার্সরা নজিরবিহীন উদাহরণ রেখেছেন। তাঁরা এ যাবৎকালে ১১ জন করোনা প্রসূতির সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। যেখানে অন্য হাসপাতালগুলো এই করোনা প্রসূতিদের ফিরিয়ে দিয়েছে। আহ! কী মানবিক!

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বাবাকে হাসপাতালে রেখে চলে যাওয়ার সময় সন্তান বলে গেছেন, ‘মারা গেলে ফোনে জানাবেন।’ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শত চেষ্টা করেও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় স্বেচ্ছাসেবী দল কোয়ান্টামে খবর দেয়। হায়! নিজের ছেলে, যাকে তিল তিল করে গড়ে তোলেন, যাকে কোনো আঘাত পেতে দেননি এ মা-বাবা। আজ সেই অমানবিক সন্তান বাবার লাশ পর্যন্ত নিতে নারাজ নভেল করোনাভাইরাসের জন্য। এটি শুধু বাংলাদেশের চিত্র নয়, সারা বিশ্বের চিত্র।

করোনাভাইরাস আমাদের ব্যাপক পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে। কোভিড-১৯ বিশ্বে যে চরম ভয়াবহতা নিয়ে হাজির হয়েছে তা আমরা কল্পনা করতে পারছি না। কোনো সন্দেহ নেই, এটি পৃথিবীর সমাজব্যবস্থা, চিকিৎসাব্যবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবনব্যবস্থা, চিন্তা-চেতনায়, জীবিকা ও মানবিকতার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদেরা করোনাভাইরাসের কাছে নতজানু হয়েছে।

কয়েক দিন আগে টঙ্গীর এক হাসপাতালে এক প্রসূতি সন্তান জন্ম দেন। হাসপাতালের বিল দিতে ওই দম্পতি হিমশিম খান, কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁদের বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করলে তাঁরা বাধ্য হয়ে নবজাতক সন্তানকে বিক্রি করে হাসপাতালের বকেয়া পরিশোধ করেন। পরে পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় শিশুটিকে উদ্ধার করে দম্পতির কোলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এইতো আমাদের মানবিকতা।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

সারা দেশে ১০ হাজার বেসরকারি ক্লিনিক আছে, কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত প্রসূতি মহিলার প্রতি খুব কমসংখ্যক ডাক্তার স্বাস্থ্যকর্মী নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা প্রদান করেন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের তথ্য অনুসারে, কিছুদিন আগে গাইবান্ধায় এক প্রসূতি প্রসববেদনায় ছটফট করতে থাকলেও কোনো হাসপাতাল তাঁকে চিকিৎসা না দেওয়ায় ওই মহিলা রাস্তায় সন্তানের জন্ম দেন। হায়! আমাদের কী মানবিকতা!
পোশাককর্মী নজরুল ইসলাম (৫৫, নারায়ণগঞ্জ) করোনার উপসর্গ নিয়ে বাসায় গেলে স্ত্রী-সন্তান তাঁকে কোনোভাবেই ঘরে আশ্রয় দেননি। যদিও তাঁর আশ্রয় মেলে বোনের বাড়িতে, এমনকি বোনের বাড়িতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। অথচ জীবনের সব রোজগারই ব্যয় করেছিলেন স্ত্রী-সন্তানের পেছনে। আবার এমনও দেখা যাচ্ছে, লাশ দাফন ও সৎকার পুলিশ সুপার (সদর কুমিল্লা) নিজেই করেছেন। স্বজনেরা এক মুঠো মাটি দিতেও আসেননি।
অথচ সেই মায়ের সন্তান, যারা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, আল মার্কাজুল ইসলামসহ অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত লাশ দাফন করে চলছেন। সেই সব মৃতদেহ দাহ, গোসল, দাফন-কাফন বা সৎকার করে যাচ্ছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। তাঁরা এ পর্যন্ত ৪০০+ লাশ দাফন/সৎকার করছেন। তাঁরা কি নিবেদিত প্রাণ!
অন্যদিকে, সম্মুখযোদ্ধারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সারা দেশে চষে বেড়ান। নিজেদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি ও পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্যের ঝুঁকি—সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে তাঁদের চলতে হয়।
আমরা এমন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যা কয়েক মাস আগেও মানুষ ভুলেও ভাবতে পারেনি। করোনায় এখন মৃত্যু হলে কোনো ধরনের প্রচার প্রচারণা বা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করেও না। সবাই এটাই ভাবে, ‘যে যাওয়ার সে চলে যাবে আর যে থাকার সে বেঁচে থাকবে। হায়াত-মউত আল্লাহর হাতে।’
আমাদের পাশের দেশ ভারতে লকডাউন শিথিল করা হলে, মদ কেনার জন্য দীর্ঘ লাইন পড়ে যায়, মাথার ওপর কড়া রোদ আর তুমুল বৃষ্টি এলেও সেই লাইনের দৈর্ঘ্য এতটুকুও কমেনি। সর্বোচ্চ রেকর্ড করেছে ভারত, মাত্র ১ দিনে ১০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি করে। এ মদ কেনার প্রতি আগ্রহ দেখে মদের ওপর ৭০ শতাংশ কর আরোপ করা হয়। যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত করোনা নিয়ে আতঙ্কে থাকে, আর সেখানে কিছুসংখ্যক বিবেকহীন মানুষ মদ্যপানের স্বাদ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারে না।

করোনা রোগীর প্রতি অমানবিক হবেন না, হয়তো কালকে এমন মৃত্যু আপনারও হতে পারে। আমাদের উচিত হবে এই সময়ে অনাহারীকে অন্ন দেওয়া, গৃহহীনকে আশ্রয় দেওয়া, নিরাপত্তা দেওয়া, সার্বিক সহযোগিতা করা। করোনা-পরবর্তী দেশের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে যেভাবে রক্ষা করতে হবে, ঠিক তেমনি মানবিক হতে হবে আগের চেয়ে অনেক বেশি। করোনার অভিজ্ঞতা যেন মানুষকে অমানবিক না করে দেয়। সামাজিক দূরত্ব তৈরি হলেও যেন মানসিক দূরত্ব তৈরি না হয়। আমরা যেন আত্মকেন্দ্রিক না হই। আমাদের মধ্যে সহমর্মিতা বা সৌহার্দ্য না থাকলে এলে আমরা ধীরে ধীরে রোবটে পরিণত হব। রোবটের পৃথিবী সত্যিই ভয়াবহ।
*উদ্যোক্তা