উপনিবেশের ইতিহাস, একজন ফ্লয়েড এবং গণজাগরণ

উপনিবেশের ইতিহাস যদিও অনেকটা মর্মান্তিক এবং বর্বর, কিন্তু অধিকাংশ ব্রিটিশের কাছে বিষয়টি সে রকম নয়। তাঁরা বরং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং এর অতীত ইতিহাস নিয়ে গর্বিত। ২০১৪ সালের এক জনমত জরিপে দেখা গিয়েছিল, শতকরা ৫৯ ভাগ ব্রিটিশ মনে করেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাঁদের জন্য গৌরবের বিষয়। শতকরা ৪৯ ভাগ এটিও মনে করেন যে ব্রিটিশরা তাঁদের উপনিবেশ দেশগুলোকে বেশ ভালো অবস্থায় রেখে এসেছিল (ইউগভ জরিপ, ২০১৪)।

বিষয়টি নিয়ে উপনিবেশ শাসনের অবসানের পর প্রায় গত অর্ধশতকের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এবং ইতিহাসবিদেরা একই সুরে কথা বলে যাচ্ছেন।
ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ নিয়াল ফার্গুনসন মনে করেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বৈশ্বিক কল্যাণের জন্য ভালো ছিল। ২০১৩ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারত সফরে এসে বলেছিলেন, ব্রিটিশ শাসন ভারতবর্ষের জন্য নিট সাহায্য ছিল। এককথায় ব্রিটিশরা তাদের অতীত সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে সবাইকে ভালো ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এমনকি ব্রিটেনের স্কুল–কলেজের ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে ব্রিটিশ উপনিবেশকে দেখানো হয় দাসপ্রথার বিলুপ্তির কারণ হিসেবে, শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মূলে, রেলপথ, ব্রিজ নির্মাণসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে এবং সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরণসহ আরও অনেক মহৎ কাজের কারণ হিসেবে। যদিও তাদের এই মনোহরি দাবি অনেকেই খুব সহজে গ্রহণ করেননি। এমনকি খোদ ব্রিটেনে অনেকেই বিষয়টিকে মানতে রাজি নন বহু আগে থেকে। যেমন, আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের কথাই ধরি। তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ প্রকৃতিবিদ। ১৮৯৮ সালে তিনি একটি বই লিখেছিলেন ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল সেঞ্চুরি’ নামে। বইটিতে তিনি গত ১০০ বছরে ব্রিটেনের অর্জন, সফলতা, উন্নতি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। বইটির শেষ দিকে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ব্রিটিশরা তাদের শাসনাধীন জাতিগুলোর সঙ্গে ভালো ও মন্দ মিশ্রিত একধরনের অদ্ভুত আচরণ করেছিল।

যা–ই হোক, যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপলিসে পুলিশের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের পর এর প্রতিবাদ জানাতে ব্রিটেনের জেগে ওঠা মানুষগুলোর প্রতিবাদের ধরন কিন্তু আবারও ইঙ্গিত করছে যে ব্রিটেন তার উপনিবেশ শাসন নিয়ে যতই গর্ব করুক না কেন, সেই ইতিহাস খুব সুখকর কিছু ছিল না। মানুষগুলো জর্জ ফ্লয়েড হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে উপনিবেশ শাসকদের বিভিন্ন ভাস্কর্য ধ্বংস ও ভাঙতে শুরু করেছে। এই উপনিবেশের ইতিহাসে দাসপ্রথা, বর্ণবাদ ও মানুষ হত্যার উপস্থিতি রয়েছে। আর সেটাই হচ্ছে এর মূল কারণ।

শুরুটা হয়েছে ব্রিস্টল থেকে। দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ডের এই শহরে জমায়েত হওয়া বিক্ষোভকারীরা দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টনের মূর্তি ভেঙে ফেলেছে। এই এডওয়ার্ড কোলস্টন ছিলেন উপনিবেশ আমলের একজন দাস ব্যবসায়ী। ছিলেন রয়্যাল আফ্রিকান কোম্পানির একজন কর্মকর্তা। তখন ব্রিটেনে দাস ব্যবসার একচেটিয়া কর্তৃত্ব ছিল এই কোম্পানির হাতে। ১৬৮৯ সালে কোলস্টন এই কোম্পানির ডেপুটি গভর্নর হয়েছিলেন। তিনি ১৬ শতকের শেষ দিকে দাস ব্যবসা করে প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছিলেন। কোলস্টন আফ্রিকা থেকে প্রায় ৮০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশুকে আমেরিকায় নিয়ে গিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। ১৭২১ সালে মৃত্যুর সময় কোলস্টন তাঁর সম্পদ দাতব্য সংস্থাগুলোতে দান করে যান যদিও। ব্রোঞ্জের তৈরি তার এই ভাস্কর্যটি গড়া হয়েছিল ১৮৯৫ সালে। কিন্তু একজন দাস ব্যবসায়ী হওয়ার কারণে কোলস্টনের এই ভাস্কর্য বহুবর্ণের এই শহরে বেশ বিতর্কের সৃষ্টি করছিল।

গত রোববার ব্রিস্টলের রাস্তায় মিছিল করেছে প্রায় ৫ হাজার মানুষ। তারা ভাস্কর্যটি প্রথম রশি দিয়ে টেনে ভেঙে ফেলে। এরপর সেটির ঘাড়ের ওপর এক বিক্ষোভকারীকে হাঁটু চেপে থাকতেও দেখা গেছে, ঠিক যে কায়দায় পুলিশ ফ্লয়েডের ঘাড়ে হাঁটু চাপা দিয়েছিল। পরে ভাস্কর্যটি টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে নদীতে ফেলা হয়।

এরপর এখন দাবি উঠেছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সিসিল রোডসের ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার। গত মঙ্গলবার এই ভাস্কর্য সরানোর দাবিতে ফের বহু মানুষ ওই এলাকায় জড়ো হন। তাঁরা ‘টেক ইট ডাউন’ এবং ‘শেম অন ইউ’ বলে স্লোগান দিচ্ছিল। সিসিল রোডস দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের একজন বিরাট কান্ডারি ছিলেন। তিনি পরে তৎকালীন কেপ কলোনির প্রধানমন্ত্রী ও হয়েছিলেন। এই কেপ কলোনিই হচ্ছে বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকা। তিনিই আফ্রিকাতে হীরার খনিগুলো কবজা করার মূল নায়ক। অসম্ভব বর্ণবাদী আর দাম্ভিক ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীতে একমাত্র ব্রিটিশরাই সেরা। তিনি বলতেন, ইংলিশম্যান হয়ে জন্মগ্রহণ করা আর জীবনের লটারিতে প্রথম পুরস্কার পাওয়া একই কথা।

আমাদের এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ শুরু হয়েছিল রবার্ট ক্লাইভের হাত ধরেই। পলাশী যুদ্ধের মূল ষড়যন্ত্রের হোতা রবার্ট ক্লাইভ অত্যাচারের প্রতীক। তিনি ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষদের জন্য অত্যাচারের প্রতীক। তাঁর নেতৃত্বে মানুষ খুন, লুণ্ঠন সবই হয়েছে ভারতে। পশ্চিম ইংল্যান্ডের শ্রেসবেরিতে রয়েছে তাঁরও একটি ভাস্কর্য। এটির নাম ক্লাইভ অব ইন্ডিয়া। সেই ভাস্কর্য সরানোর জন্য এখন শ্রেসবেরির কান্ট্রি কাউন্সিলে দাবি তুলেছেন শত শত মানুষ। তাঁদের দাবি হচ্ছে, উপনিবেশের কালো ইতিহাস কি এখনো ব্রিটেনের ‘গর্ব’ বয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।

আর এখন খোদ লন্ডনের মেয়র সাদেক খানও একই কথা বলছেন। তাঁর মতে, দাস ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নগরীর সব ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা উচিত, এবং রাস্তার নাম বদলে দেওয়া উচিত। তিনি মনে করেন, অপ্রিয় হলেও এটি সত্য যে ব্রিটেন এবং লন্ডনের ঐশ্বর্যের সঙ্গে দাস ব্যবসার একটি ঐতিহাসিক যোগাযোগ রয়েছে (বিবিসি বাংলা, ৯ জুন, ২০২০)।

ভারতের সাবেক মন্ত্রী, রাজনীতিবিদ, জাতিসংঘের সাবেক কূটনৈতিক এবং লেখক শশী থারুর ‘এন এরা অব ডার্কনেস (২০১৬)’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইখানা পরে ব্রিটেন থেকে ‘ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার—হোয়াট দি ব্রিটিশ ডিড টু ইন্ডিয়া (২০১৭)’ নামে প্রকাশিত হয়। তাঁর মতে, ভারতবর্ষ শাসনকালে ব্রিটিশরা যা করেছিল তা রীতিমতো দানবীয় অপরাধ। ব্রিটিশরা আসার আগে এখানকার অর্থনীতির আয়তন বিশ্ব অর্থনীতির মোট ২৩ শতাংশ ছিল। ব্রিটিশরা এখান থেকে যাওয়ার সময় যার পরিমাণ ৪ শতাংশে নেমে এসেছিল। ব্রিটিশরা ভারতে আসার আগে বিশ্বের বস্ত্রশিল্পের মোট ২৭ শতাংশ রপ্তানি হতো ভারত থেকে, যা ব্রিটিশ শাসনের সময়কালে ২ শতাংশে নেমে গিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসন আমলে তাদের নীতি প্ররোচিত দুর্ভিক্ষে প্রায় ১৫ থেকে ২৯ মিলিয়ন ভারতীয় মারা গেছেন।

শশী থারুর আরও লিখেছেন, ব্রিটিশরা উপমহাদেশে রেলের প্রচলন করেছিল তাদের লাভের জন্য। ভারতের লাভের জন্য নয়। ১৮৪৩ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড হার্ডিঞ্জ এবং পরে ১৮৫৩ সালে লর্ড ডালহৌসি এই যুক্তি দেখান যে ভারতবর্ষকে রেল নেটওয়ার্কে যুক্ত করতে পারলে ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ ও বাজারজাত সহজ হবে। সেই সঙ্গে ভারতবর্ষ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে ব্রিটেনের শিল্পকারখানাগুলোতে পাঠানো যাবে। এই রেললাইন নির্মাণেও ছিল চুরি ও লুণ্ঠন। বার্ষিক ৫ শতাংশ নিশ্চিত লাভে রেললাইন তৈরির প্রকল্পে টাকা খাটিয়ে ব্রিটিশ মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা প্রচুর অর্থের মালিক হন। সেই সময় ভারতে প্রতি মাইল রেললাইন নির্মাণে খরচ হয়েছিল ১৮ হাজার পাউন্ড। অথচ আমেরিকাতে তখন প্রতি মাইল নির্মাণে খরচ হয়েছিল ২ হাজার পাউন্ড।

ব্রিটিশ কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে গত বছর প্রকাশিত ভারতীয় অর্থনীতিবিদ উষা পাটনায়েকের গবেষণায় দেখা যায় যে ১৭৬৫ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে ব্রিটিশরা আত্মসাৎ করেছে প্রায় ৭৫ ট্রিলিয়ন ডলার। আর এই অর্থ পাচার হয়েছিল বাণিজ্যের আড়ালে। অর্থের এই অঙ্ক বর্তমানে ব্রিটেনের মোট জিডিপির ১৭ গুণ বেশি। ব্রিটিশ শাসনামলে ভারতীয়দের মাথাপিছু আয় বাড়েনি বরং কমে গিয়েছিল। ১৮৭০ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারতীয়দের গড় আয়ুকাল কমে গিয়েছিল এক–পঞ্চমাংশ।

তারা যখন শোষণের কারণে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে তখন খুবই নিষ্ঠুর আচরণ করেছে। লাখ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। আসলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সৃষ্টি হয়েছিল নিজ দেশ ব্রিটেনকে সমৃদ্ধ করার জন্য। কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে নয়। তাই উপনিবেশ দেশগুলোকে লুণ্ঠন, অত্যাচার, বর্ণবাদ, দাসপ্রথা, নিপীড়ন, শোষণ, লোভী ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, ব্যক্তিগত লোভ–লালসা, জাতিগত বিভেদ এসব অনেক কিছুই মোকাবিলা করতে হয়েছে।

আবার শশী থারুরের কথায় ফিরে আসি। তিনি মনে করেন, ব্রিটেনের উপনিবেশবাদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য তাদের (ব্রিটেন) ভারত উপমহাদেশকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। তিনি মূলত কোনো আর্থিক ক্ষতিপূরণের কথা বলেননি। তাঁর দাবি, ব্রিটেনের উচিত তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়া। তিনি এটাও মনে করেন, বর্তমান ব্রিটেন তার অতীতের কৃতকর্মের জন্য দায়ী নয়। তাই তাঁর মতে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি বর্তমান ব্রিটেন নীতিগতভাবে মেনে নিলেই যথেষ্ট।

সাম্রাজ্যবাদের জন্য ব্রিটেনের এই ক্ষমা চাওয়ার দাবি অনেক পুরোনো। কিন্তু ব্রিটেন বরাবরই তা উপেক্ষা করে এসেছে। ২০১৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন অমৃতসার গণহত্যার স্থান পরিদর্শনকালে ব্রিটিশদের হুকুমে হাজারো ভারতীয় হত্যার বিষয়টিকে তিনি লজ্জাজনক ঘটনা বলে অভিহিত করলেও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি তিনি প্রত্যাখ্যান করেন।

চ্যান্সেলর থাকাকালে আরেক সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন বলেছিলেন, ব্রিটেনের উপনিবেশবাদের জন্য ক্ষমা চাওয়ার দরকার নেই। বরং ব্রিটেনের উচিত স্বাধীনতা এবং সহনশীলতার বিষয়ে ব্রিটিশ মূল্যবোধের বিষয়টিকে প্রচার করা। আবার অনেকেই বলেন স্থান, কাল ও পাত্রভেদে সব সাম্রাজ্যবাদের ধরন একই। ব্রিটিশরাও ৪০০ বছর রোমান দ্বারা শাসিত হয়েছে। তাই বলে তারা রোমানদের কাছে এই রকম কিছু দাবি করেনি।

রাশিয়ান লেখক লিও তলস্তয় একবার মাহাত্মা গান্ধীকে দেওয়া একটি চিঠিতে আমাদের এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তিনি ভেবে অবাক হন যে কীভাবে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যবসা করতে এসে লুটপাট আর শোষণে জড়িয়ে গেল। তিনি আরও লিখেছিলেন, এটি হয়তো সম্ভব হয়েছে মানবতার মধ্যে নিহিত ভালোবাসাকে সম্পূর্ণভাবে হৃদয়ঙ্গম না করার কারণে। হয়তো বিষয়টি সেটাই। খোদ ব্রিটেনের তৎকালীন সাধারণ জনগণ বা এখনকার সাধারণ জনগণ উপনিবেশবাদের সঠিক ইতিহাস জানলে বিষয়টি হয়তো সানন্দে গ্রহণ করবে না। আর ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সৃষ্ট পরিস্থিতি সেটাই জানান দিচ্ছে।

* বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। [email protected]