শ্রীমঙ্গলের স্মৃতি

চা–বাগানে ঢাবির ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত
চা–বাগানে ঢাবির ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগের মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা। ছবি: সংগৃহীত

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুর দিনগুলো ছিল অন্য রকম। নতুন বন্ধু, নতুন পরিবেশ, হলের জীবন, প্রথমবার বাসা থেকে অনেক দূরে থাকতে শেখা—এমন হাজারো নতুন নতুন অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। এর পাশাপাশি ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট আর প্রেজেন্টেশনের চাপ তো ছিলই। দীর্ঘ ক্লান্তি শেষেও একখণ্ড অবসর খুঁজে পাওয়া ছিল দুরূহ। তাই সবাই সিদ্ধান্ত নিল ব্যস্ততার ফাঁকেই কোথাও থেকে ঘুরে আসার।

ক্লাস, পরীক্ষার রুটিনে বাঁধা জীবন আর শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি পেতে সপ্তাহান্তে শ্রীমঙ্গল ঘুরে আসার পরিকল্পনা হলো। সাথি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক শিক্ষার্থী। গন্তব্য চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গল। এই ট্যুরটির আয়োজক ছিল ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স সোসাইটি অব মুহসীন হল (BISM)।
গত বছর ২৫ জুলাই রাতে বর্ষার মৃদু বৃষ্টি আর আকাশের চোখরাঙানির মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এটি ছিল সিলেট অঞ্চলের দিকে আমার প্রথম যাত্রা। তাই ট্যুর নিয়ে রোমাঞ্চও ছিল অনেক বেশি। প্রায় ছয় ঘণ্টার যাত্রা শেষে যখন শ্রীমঙ্গলে পা রাখলাম, তখন কাকডাকা ভোর। পানসি রেস্টুরেন্টে সকালের খাবার খেয়ে সেরে সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলাম।

মেঘলা আকাশের নিচে চাঁদের গাড়িতে করে শুরু হলো যাত্রার দ্বিতীয় পর্ব। গন্তব্য হামহাম জলপ্রপাত। সারি সারি টিলা আর চা-বাগানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকল আমাদের চাঁদের গাড়ি। সঙ্গে জহির ভাইয়ের গান, ‘চলে আমার চান্দের গাড়ি...’। এই যাত্রাটা ছিল অসম্ভব মনোরম। আশপাশে চা-বাগান, মেঘলা আকাশ, শীতল হাওয়া সব মিলিয়ে ট্যুরের এই অংশটি ছিল চমৎকার!
চাঁদের গাড়ির দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে এবার ট্রেকিংয়ের পালা। তিন দিনের ট্যুরের সব থেকে রোমাঞ্চকর অংশ বোধ হয় এটিই। একের পর এক টিলা, উঁচু–নিচু কর্দমাক্ত পথ, জোঁকের আক্রমণ, ঝিরিপথ পেরোতে গিয়ে বারবার মনে হচ্ছিল ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঝরনা পর্যন্ত পৌঁছানো যাবে কি না। অবশেষে তিন ঘণ্টার ট্রেকিং শেষে আমরা এসে পৌঁছালাম হামহাম জলপ্রপাতে। ঝরনার হিমশীতল পানি দীর্ঘযাত্রার ক্লান্তি নিমেষেই ভুলিয়ে দিল। ঘণ্টাখানেক ঝরনার পানিতে গা ভিজিয়ে আবারও পাহাড়ি টিলা ধরে ফিরতে হলো গন্তব্য শুরুর স্থানে। যাওয়ার সময় পথটুকু যত দীর্ঘ আর সীমাহীন মনে হচ্ছিল, ঝরনা থেকে ফেরার পথে ততটা মনে হলো না।
স্থানীয় একটা হোটেলে দুপুরের খাবার শেষে এবার বিশ্রামের পালা। এরপরের সময়টুকু পার হলো নয়নাভিরাম নিসর্গ রিসোর্টে। সন্ধ্যা নামতেই পাহাড়ি পোকাদের ডাক, নিশুতি রাত আর ঘন অন্ধকার এক অলৌকিক পরিবেশের অবতারণা করল। সারা দিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় যেতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরদিনের গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। রিসোর্ট থেকে কিছুটা পথ হেঁটে, কিছুটা পথ বাসে চড়ে পৌঁছে গেলাম উদ্যানে। পুরো উদ্যান জানা-অজানা অসংখ্য প্রজাতির গাছে ভরপুর। উদ্যানের প্রধান ফটক পেরিয়ে কিছুদূর এগোলেই দেখা যায় বনের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া আঁকাবাঁকা রেলপথ। এই রেললাইনেই দৃশ্যায়ন হয়েছিল জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটির। যার কারণে রেললাইনটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এরপর আমরা হাঁটা শুরু করলাম আরও গহিনে। লক্ষ্য বনের যত দূর পর্যন্ত পারা যায়, এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু মাঝপথে বাদ সাধল বৃষ্টি। অগত্যা ফিরে আসতে হলো উদ্যানের মূল সড়কের দিকে। ততক্ষণে সকাল গড়িয়ে দুপুর। উদ্যান থেকে বেরিয়ে সোজা ছুটলাম নূরজাহান টি রিসোর্টে। চা-বাগানগুলো যেন ভাতঘুমে বিভোর। নিশ্চুপ সবুজের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছিল ফেলুদার চা-বাগান নিয়ে লেখা গোয়েন্দা কাহিনির কথা। ঠিক যেন সে সময়টিতেই আমরা পৌঁছে গেছি। গা ছমছমে নির্জনতায় বিস্তৃত চা-বাগানকে আরও রহস্যময় মনে হতে লাগল। দেখতে দেখতেই সময় ফুরিয়ে গেল। দুপুরের খাবার সেরে গেলাম শ্রীমঙ্গল বধ্যভূমিতে। তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, ঘণ্টাখানেক পর ফিরতি বাস। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল, দেশের সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী বৃষ্টি। যেন আমাদের বিদায়বেলায় শ্রীমঙ্গলের আকাশেও বাজছে বিষাদের ঘনঘটা।
শ্রীমঙ্গলকে বিদায় জানিয়ে ছুটলাম ঢাকার পানে। সঙ্গে নিয়ে অগণিত স্মৃতি। আধো ঘুমে ছয় ঘণ্টার যাত্রা শেষে ফিরে এলাম ঢাবির প্রিয় হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বন্ধুদের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরা হলেও এটিই ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম ট্যুর। আবার BISM–এরও প্রথম ট্যুর এটি। তাই আনন্দের মাত্রাটা ছিল স্বাভাবিকের চেয়েও বেশি। আমান ভাই বলেছিলেন, ট্যুরে আসলে নিজেকে চেনা যায়, শেখা যায় অনেক কিছু। আসলেও তাই। এই ছোট্ট একটা ট্যুর অভিজ্ঞতার ঝুলি বাড়িয়ে দিল অনেকখানি। এনে দিল আরও কিছু রঙিন স্মৃতি। এসব স্মৃতি হাতড়েই আমাদের নিত্য বেঁচে থাকা।

শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। রংপুর সদর, রংপুর। [email protected]