প্রযুক্তির নয়া সামাজিকীকরণ

একজন শিক্ষক অনলাইনে শিক্ষার্থীদের পাঠ দিচ্ছেন এমন একটি ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ছবিটি পুনের একজন রসায়ন শিক্ষকের। ছবিটি ভাইরাল হওয়ার কারণ, তিনি মুঠোফোনটিকে খুবই ঘরোয়া কায়দায় থিতু করে ক্লাসে পাঠ দিচ্ছেন। যেহেতেু তাঁর ঘরে ক্যামেরা দাঁড় করানোর ট্রাইপড নেই, তাই তিনি নিজের মতো করেই কাজটি করেছেন।

সবকিছু ছাপিয়ে ছবির যে ভাষ্য তা হলো, একজন শিক্ষক নিরলসভাবে ‘শতভাগ’ শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানোর চেষ্টা করছেন। এই দৃশ্য শুধু ভারতের পুনেতে নয়, বরং বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশের ঘরে ঘরে পাওয়া যাবে। এই যে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা মিলে নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রমকে গতিশীল রাখার জন্য, এই প্রচেষ্টা পৃথিবীর বহু দেশের কাছে অনুকরণযোগ্য হয়ে উঠছে। আজকের দিনে যাঁরা লড়াই করছেন, এসব শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে মানুষ মনে রাখবে কি রাখবে না, আমরা হয়তো তা এখনই বলতে পারব না। তবে আমাদের কর্তব্য হলো, তাঁদের প্রতি সম্মান ও সাধুবাদ দেখানো।

আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, তবু বারবার দেখেছি যে চেষ্টা ও ইচ্ছার কাছে সেই সীমাবদ্ধতা হার মেনেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেভাবে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, মনের জোরে, এখনো আমরা দেখছি নানান নেতিবাচক বিষয় থাকলেও শিক্ষাক্ষেত্রে একটা বিপ্লব হচ্ছে। যে তরুণ প্রজন্ম নিজেদের হাতে থাকা ডিভাইসগুলোর যথাযথ ব্যবহার করত না, তারা এগুলো এখন পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করছে। অনেক দামি ফোনটা আগে শুধু কথা বলার জন্য ব্যবহার হতো, সেটা এখন টেলিভিশন স্টেশন, রেডিও স্টেশন বা রেকর্ডিং স্টুডিও হয়ে গেছে। আমাদের হাতে থাকা প্রযুক্তিপণ্যটি সার্থকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একটা সময় আমরা হয়তো জানতামই না অনেক দামে কেনা একটি স্মার্টফোন আনস্মার্টলি ব্যবহার করছি। সেই ফোনই এখন ক্যামেরার কাজ করছে, হয়েছে ভিডিও এডিটর। এই প্রযুক্তিপণ্যের হাত ধরে বিদ্যালয় আমাদের ঘরে চলে এসেছে, অথবা বিদ্যালয়কে আমরা হাজার মাইল দূরে থাকা শত শিক্ষার্থীর দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছি।

একটা সময় ছিল যে স্মার্টফোন বা এসব প্রযুক্তিপণ্য আমাদের ছেলেমেয়েরা লুকিয়ে ব্যবহার করত। অভিভাবকেরাও এই পণ্য ব্যবহারকে খুব বেশি ভালো চোখে দেখতেন না। এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। সেই অভিভাবক এখন তাদের ডিভাইসগুলো আপডেট করে নিচ্ছেন নিজের সন্তানদের মাধ্যমে। সন্তানও মা–বাবার সঙ্গে শেয়ার করছে নিত্য নতুন বাস্তবতা। প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি ‘নয়া সামাজিকীকরণ’ ঘটে যাচ্ছে। শিক্ষা এখন মুক্ত হচ্ছে, আরও মুক্ত হবে। অর্থাৎ শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা খুঁজে নিতে শিখছে। শিক্ষকও তাঁর যথার্থ শিক্ষার্থীকে খুঁজে নেবেন এবং মাঝখানে প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সমন্বয় ঘটাতে পারে সঠিকভাবে, তাহলে হয়তো তারা টিকে থাকবে। অন্যথায় শিক্ষা ‘ওপেন সোর্স’–এর আওতায় চলে যাবে।

এই যে জায়গাটি তৈরি হয়েছে অর্থাৎ প্রযুক্তি ব্যবহারকে আমরা যে জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি, সেটি আগামী প্রজন্মের মাধ্যমে এই দেশকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমরা একটা জিনিস তো বুঝতে পারছি, যে প্রযুক্তিপণ্যটি ব্যবহার করা হতো ফান বা বিনোদন হিসেবে, যে পণ্যটি ছিল আভিজাত্য—সেটি এখন অনিবার্য হয়ে প্রয়োজন মেটাচ্ছে। আমাদের অনেকের জীবিকার বাহন হয়ে উঠেছে। এই প্রযুক্তির ব্যবহারকে আরও সমুন্নত করতে গবেষণা বাড়াতে হবে। আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যৌথভাবে যে কাজ করছে, সেটি অবশ্যই একদিন সুন্দর আগামীর পথ দেখাবে।