মাশরাফীদের বাড়িতে একদিন

বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রভ্রমণ। ছবি: সংগৃহীত
বন্ধুদের সঙ্গে সমুদ্রভ্রমণ। ছবি: সংগৃহীত

তিন মাস কেটে গেল। আমাদের দেখা না হওয়ার দিনগুলো আরও দীর্ঘতর হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরার আকুতি ঘনীভূত হচ্ছে। সব আগের মতো ফিরে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় দিন গুনছি।

রাত নামলে ভিসি চত্বরের আড্ডা অবচেতন মনে ফিরে ফিরে আসে। ইনকোর্স, মিডটার্ম আর সেমিস্টার ফাইনালের ছকে বাঁধা জীবনে রাতে ভিসির আড্ডা, ক্যাম্পাসে একসঙ্গে কোরাস গাওয়া এসবই তো ভরসা। ক্যাম্পাসের ছকে বাঁধা জীবন থেকে যখনই ফুসরত মিলেছে তখনই বন্ধুরা মিলে দিয়েছি ছুট।

মনে পড়ে সেই টাঙ্গুয়ার হাওরের দিনগুলো। রাতের ট্রেনে বন্ধুরা মিলে হইহুল্লোড় করতে করতে সকাল অবধি পৌঁছে গেলাম নেত্রকোনায়। নেত্রকোনা থেকে সোজা সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর। হাওরের ওয়াচটাওয়ারে পৌঁছে ছোট নৌকা নিয়ে ঘণ্টাব্যাপী রেসের কথা ভুলি কী করে! সারা দিন দাপাদাপি করে রাতের হাওরে নৌকায় গা এলিয়ে দিয়ে হাওরের নিস্তব্ধতাকে যেন আরও কাছে পাই। নীলাদ্রি লেক, সিরাজ লেক, জাদুকাটা নদী আর শিমুল–বাগানের সৌন্দর্যের মায়া কাটিয়ে আবার ঢাকার জনজীবনে ফিরতে হয়। জীবন তো এভাবেই চলে।

তবে সে যাত্রায় জলের মায়া ঠিক কাটেনি। পরের সেমিস্টারের শুরুতে বন্ধুরা মিলে চেপে বসি সেন্ট মার্টিনের বাসে। রাতের জার্নি শেষে খুব ভোরে নেমে পড়ি টেকনাফে। টেকনাফ থেকে জাহাজে করে একদম সেন্ট মার্টিন দ্বীপে। কী অসাধারণ সৌন্দর্য! সেন্ট মার্টিন আমাদের মুগ্ধ করে। সারা দিন ঘোরাঘুরির পর রাতের দ্বীপ যেন ঠিক অন্য ভুবন। সমুদ্রের তীরে বসে সমুদ্রের আওয়াজ আমাদের সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। মধ্যরাত অবধি বন্ধুরা দল বেঁধে তীর ধরে হেঁটে বেড়িয়েছি পুরো দ্বীপ। সেন্ট মার্টিনকেও বিদায় জানাতে হয়েছে। সেন্ট মার্টিনে তিনটি দিন আমাদের এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে।

চা–বাগানে ঘোরাঘুরি। ছবি: সংগৃহীত
চা–বাগানে ঘোরাঘুরি। ছবি: সংগৃহীত

আবার বুঁদ হয়ে পড়ি পড়াশোনায়। তবে মন সব সময়ই ছুটির জন্য হাঁসফাঁস করে। এবার ছুটি বন্ধু আবিদের শহর নড়াইলে। আবিদের বাসায় পৌঁছে মন আকুপাকু করে বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মুর্তজা ভাইয়ের বাসায় ঢুঁ মারতে। ম্যাশ ভাইয়ের বাসা আবিদদের বাসার প্রায় কাছাকাছিই। এমনিতেই ওরা ম্যাশ ভাইয়ের পরিবারের পূর্বপরিচিত। অনুমিতভাবেই বেগ পেতে হয়নি। ম্যাশ ভাইয়ের বাসায় খুব ভালো সময় কাটল। তবে নড়াইল এসে এস এম সুলতানের জাদুঘর এবং চিত্রা নদী দেখব না, তা তো হয় না। দুদিন আবিদের বাসায় অসাধারণ আপ্যায়ন পেলাম। সেখান থেকে ছুট লাগাই খুলনার পথে। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দেখে ফিরতে হয়। ফিরে আসি সেই চিরচেনা ঢাকায়।

সেবার অনেক দিন ধরে বান্দরবানে যাওয়ার প্ল্যান হচ্ছিল। শেষমেশ যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়। বান্দরবানের ভ্রমণটা অসাধারণ ছিল। নীলগিরি, নীলাচল, স্বর্ণমন্দির, চিম্বুক পাহাড় দেখার পর্ব শেষ করে চট্টগ্রামের পথ ধরি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, খৈয়াছড়া ঝরনা দেখার স্মৃতি সম্বল করে সেই ঢাকায়ই ফিরতে হয়।

মিডটার্মের ধকল কাটিয়ে পরেরবার খুব সম্ভবত নরসিংদী চলে যাই। নরসিংদীর মেঘনাতে জম্পেশ সময় কাটে। উয়ারী–বটেশ্বরকে দেখে মন দমে যায়। আদতে উয়ারী–বটেশ্বরকে যা ভেবেছিলাম তেমনটি পাইনি। এই-ই যা। দুই দিনের আপেলের বাসার আপ্যায়ন মনের দমে যাওয়াকে পেয়ে বসতে দেয়নি।

করোনাকালের পর আবার ভ্রমণপিপাসুরা বেরিয়ে পড়বেন। ছবি: সংগৃহীত
করোনাকালের পর আবার ভ্রমণপিপাসুরা বেরিয়ে পড়বেন। ছবি: সংগৃহীত

এভাবেই একে একে গত চার বছরে অসম্ভব সুন্দর সময় কেটেছে। চাঁদপুরে আবদুল্লাহর বাসার আতিথ্য, কুমিল্লায় আশিকের বাসার আতিথ্য, নীলফামারীতে জীবনের বাসার আতিথ্য কিংবা মৌলভীবাজারে তারেকের বাসার আতিথ্য কোনোটাই ভোলার নয়। গত চার বছরে এমন অসংখ্য জায়গায় বন্ধুরা মিলে পাড়ি জমিয়েছি। প্রত্যেক ট্যুরে আমাদের অসম্ভব ভালো সময় কেটেছে। প্রতিবার মজার সব কাহিনির জন্ম হয়েছে। একসঙ্গে চলার পথে খুনসুটি ছাপিয়ে আমাদের কাছে বন্ধুত্বটাই ছিল সব।

গত তিন মাসে এই বন্ধুদের সঙ্গে দেখা না হওয়ার দিনগুলোতে রাজ্যের ক্লান্তি এসে রাজত্ব করেছে। এই অমানিশা (করোনাভাইরাস) কেটে গেলে আমরা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরব। ভিসি চত্বরে মধ্যরাত অবধি আড্ডা দেব। সময়ের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আবার নদী, সাগর, পাহাড়, অরণ্যে পাড়ি জমাব। আবার রঙিন হবে আমাদের দিনগুলো।


*হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]