বিশ্ববিদ্যালয় র্যাংঙ্কিংয়ে ভালো করতে যা যা দরকার

প্রতিবছর বিশ্বের নামকরা অনেক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংঙ্কিং প্রকাশ করে। এই লেখার উদ্দেশ্য ডেটার ওপর ভিত্তি করে বোঝার চেষ্টা করা আমাদের অবস্থান আসলে কোথায়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক টাইমস হায়ার এডুকেশন কীভাবে কয়েক দিন আগে প্রকাশ করেছে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংঙ্কিং। যেখানে আছে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি কিউএস র‌্যাংঙ্কিংয়ে ৮০১ থেকে ১০০০–এর মধ্য বাংলাদেশ থেকে স্থান পেয়েছে বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

কিউএস থেকে ৫০০–এর পরের অবস্থানে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডেটা এবং সুনির্দিষ্ট অবস্থান প্রকাশ করা হয় না। তাই এই লেখায় মূলত ডেটা নেওয়া হয়েছে টাইমস হায়ার এডুকেশনের ওয়েবসাইট থেকে এবং র‌্যাংঙ্কিং প্রকাশক সংস্থা কিউএস এবং টাইমস হায়ার এডুকেশনকে ডেটা সরবরাহকারী স্কোপাস থেকে।

টাইমস হায়ার এডুকেশন কয়েক দিন আগে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাংঙ্কিং প্রকাশ করেছে, এর মধ্যে ভারতের ৫৬টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার ৪৮টি শীর্ষ ৪০০–এর মধ্যে। পাকিস্তানের ১৪টি, যার ৯টি শীর্ষ ৪০০–এর মধ্য, শ্রীলঙ্কার ২টি (১টি ৬৯তম স্থানে), নেপালের একটি, তা–ও শীর্ষ ৪০০–এর মধ্যে এবং বাংলাদেশ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (র‌্যাংঙ্কিং ৪০১+)।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরভিত্তিক বিগত পাঁচ বছরের মোট একাডেমিক আর্টিকেল সংখ্যা। তথ্যসূত্র: স্কোপাস ডেটাবেস
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরভিত্তিক বিগত পাঁচ বছরের মোট একাডেমিক আর্টিকেল সংখ্যা। তথ্যসূত্র: স্কোপাস ডেটাবেস

এবার আসুন দেখি কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে এই র‌্যাংঙ্কিংয়ে যুক্ত হতে নির্ণায়ক কী কী। টাইমস হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট অনুসারে ৩টি
১.
বিগত ৫ বছর সময়ে পর্যাপ্তসংখ্যক একাডেমিক প্রবন্ধ (বর্তমানে ন্যূনতম সংখ্যা ১০০০টি)
২.
স্নাতক পর্যায়ে পাঠদান করতে হবে
৩.
বহুমুখী বিষয়ে একাডেমিক কার্যক্রম।

টাইম হায়ার এডুকেশন একাডেমিক ডেটা নেয় এলসিভিয়ারের স্কোপাস ডেটাবেস থেকে। স্কোপাসে নিবন্ধিত হতে হলে একটি প্রকাশনাকে তাদের ন্যূনতম মান প্রমাণ করতে হয় এবং তা ধরে রাখতে হয়। তা ছাড়া কোনোভাবেই ৮০ শতাংশ আর্টিকেল একটি বিষয়ের ওপর হতে পারবে না (আর্টিকেলগুলোকে ১১টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে বিন্যাস করে থাকে এই সংস্থা)। তো বাংলাদেশের কয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ন্যূনতম যোগ্যতা আছে? স্কোপাসের ডেটা বলছে, এই হাজারি ক্লাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকে ২০০৯–এ, ২০১০–এ বুয়েট, রাজশাহী ২০১৪ সালে এবং জাহাঙ্গীরনগর ২০১৯–এ (চিত্র-১)। এই ক্লাবের ঢাকা ব্যতীত অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো টাইম হায়ার এডুকেশন র‌্যাংঙ্কিংয়ে নেই। আমি যেহেতু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেন্ড নিয়ে বেশি উৎসাহী। চবি এখনো এই ক্লাবে নেই। প্রথমবারের মতো যোগ দিতে ২০২০–এর বাকি সময়ে আরও ১১৭টি আর্টিকেল লাগবে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোপাস ডেটা অনুসারে মোট প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা চিত্র-২–এ দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কোপাস ডেটাবেসে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত সর্বমোট আর্টিকেলের সংখ্যা। তথ্যসূত্র: স্কোপাস ডেটাবেস
বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কোপাস ডেটাবেসে এখন পর্যন্ত সংরক্ষিত সর্বমোট আর্টিকেলের সংখ্যা। তথ্যসূত্র: স্কোপাস ডেটাবেস

এখন দেখা যাক টাইম হায়ার এডুকেশনের বিভিন্ন সূচকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর টপ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কতটুকু পিছিয়ে আছে (চিত্র-৩)। বলে রাখা ভালো, টাইম হায়ার এডুকেশন ৫টি সূচকে (শিক্ষাদান, ৩০%; গবেষণা, ৩০%; সাইটেশন, ৩০%; আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা, ৭.৫%; ইন্ডাস্ট্রি আয়, ২.৫%) মূলত ১৩টি ভিন্ন ভিন্ন উপসূচকে ডেটা সংগ্রহ করে থাকে। শিক্ষাদানের (সামগ্রিকভাবে শিক্ষার পরিবেশ) মধ্যে থাকে স্টেকহোল্ডারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা/মর্যাদা, স্টাফ/শিক্ষার্থী অনুপাত, ডক্টরেট/স্নাতক অনুপাত, ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত/একাডেমিক স্টাফ অনুপাত এবং আয়। গবেষণায় বিবেচনা করা হয় সংখ্যা, মান/খ্যাতি এবং আয়। সাইটেশন বলতে বোঝায় আপনার গবেষণা অন্য গবেষকেরা কতবার ব্যবহার করে। আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতায় থাকে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বিদেশি ফ্যাকাল্টির সংখ্যা এবং একাডেমিক এবং গবেষণায় অন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব। চিত্র-৩–এ ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (র‌্যাংঙ্কিং ৩৬), শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া (র‌্যাংঙ্কিং ৬৯), পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম (র‌্যাংঙ্কিং ৭৫) এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের (র‌্যাংঙ্কিং ৩৫০-৪০০) সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (র‌্যাংঙ্কিং ৪০১+) বিভিন্ন সূচকে তুলনামূলক স্কোর দেখানো হয়েছে। এই ডেটা থেকে দেখা যাচ্ছে মূলত র‌্যাংঙ্কিং নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষাদান এবং গবেষণা। গবেষণার মান যত ভালো হবে, তার সাইটেশনও ততো ভালো হবে। চিত্র-৩–এ দেখা যাচ্ছে পাকিস্তানের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয় শ্রীলঙ্কার পেরাদেনিয়া থেকে শিক্ষাদান এবং গবেষণায় এগিয়ে থাকলেও (আর্টিকেলের সংখ্যা অনেক বেশি, চিত্র-৩) সাইটেশনে অনেক পিছিয়ে। ফলে সামগ্রিকভাবে পেরাদেনিয়ার অবস্থান ৬৯ আর কায়েদ-ই-আজমের ৭৫! তার মানে র‌্যাংঙ্কিংয়ে উন্নতির জন্য মানসম্পন্ন গবেষণায় জোর দিতে হবে।

র‌্যাংঙ্কিংয়ে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূচকের তুলনামূলক অবস্থান। তথ্যসূত্র: টাইম হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট
র‌্যাংঙ্কিংয়ে উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূচকের তুলনামূলক অবস্থান। তথ্যসূত্র: টাইম হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট

টাইম হায়ার এডুকেশনের র‌্যাংঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৬, ২০১৮ এবং ২০২০ সালে অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৯১-২০০ (স্কোর ১৫.৯৬), ৩৫০-৪০০ (স্কোর ১৬.৩২) এবং ৪০১+ (স্কোর ১৭.৭১)। সামগ্রিক স্কোর কিন্তু বেড়েছে, কিন্তু নেমে গেছে অবস্থান। তার মানে একই সময়ে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় অগ্রগতি ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা যেতে পারে। ২০১৬ সালে এর স্কোর ছিল ১৬.৪১ (র‌্যাংঙ্ক ১৯১-২০০), যা ২০২০ সালে দাঁড়ায় ২৭.৫ (র‌্যাংঙ্ক ২০১-২৫০)।

কোন সূচকে পিছিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? এর উত্তর পাওয়া যাবে চিত্র-৩–এ। চার বছরে শিক্ষাদান (সামগ্রিকভাবে শিক্ষার পরিবেশ) সূচক ২ পয়েন্ট কমে গেছে। ২০১৬ সালে যেখানে এই সূচক সামগ্রিক স্কোরের ৪৮% জোগান দিত, তা ২০২০ সালে নেমে দাঁড়ায় ৩২%। ভালো দিক হচ্ছে, গত চার বছরে সাইটেশন সূচক বেড়েছে ২ পয়েন্টের কিছু বেশি। সঙ্গে অন্যান্য সূচকে স্বল্প হলেও ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ করা গেছে (চিত্র-৪)।

টাইম হায়ার এডুকেশনের এশিয়ান র‌্যাংঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরভিত্তিক অবস্থান। তথ্যসূত্র: টাইম হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট
টাইম হায়ার এডুকেশনের এশিয়ান র‌্যাংঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বছরভিত্তিক অবস্থান। তথ্যসূত্র: টাইম হায়ার এডুকেশন ওয়েবসাইট

এ অবস্থায়, বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংয়ে জায়গা করে নিতে বা অবস্থানের উন্নতি করতে চাইলে গবেষণার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নজর দেওয়ার এখনই সময়। এ জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের কর্মপরিকল্পনা সাজাতে পারে। শুধু নীতিগত সহায়তার মাধ্যমে দ্রুতই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার সংখ্যা এবং মান বাড়ানো সম্ভব। আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই স্নাতক পর্যায়ে নেই কোনো গবেষণাধর্মী কোর্স! আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই আছে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্রমে এ ধরনের কোর্স নেই, তারা যদি যুক্ত করে, তাহলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের হাজারো শিক্ষার্থীকে দ্রুত এবং সহজেই গবেষণায় যুক্ত করা যাবে। ফলে বাড়বে গবেষণার কলেবর। স্নাতকোত্তর শুরু করার আগেই শিক্ষার্থীরা পাবে গবেষণার দরকারি প্রশিক্ষণ। স্কোপাসে বাংলাদেশের দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সময়ে যাত্রা করা দুটি বিভাগের গবেষণা আর্টিকেলের সংখ্যা থেকে এই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। একই সময়ে যাদের শিক্ষাক্রমে বাধ্যতামূলক গবেষণা কোর্স ছিল, তাদের প্রকাশিত আর্টিকেলের সংখ্যা অন্যটির চেয়ে দেড় গুণ বেশি। কাজেই বলা যায়, অন্যান্য অনেক ফ্যাক্টরের সঙ্গে এই নীতিগত সহায়তাও অন্যতম একটি। সারকথা, বিশ্ব র‌্যাংঙ্কিংয়ে জায়গা পেতে হলে গবেষণায়ই দিতে হবে অগ্রাধিকার এবং আমাদের সব নীতি হতে হবে গবেষণাবান্ধব। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কি এ বিষয়গুলো ভেবে দেখবে?

*সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পিএইচডি গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য