বাবা কেন ভাঙা চশমা, ছেঁড়া স্যান্ডেল পরতেন এখন বুঝি

জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্ব বাবা দিবস। সে অনুযায়ী এ বছর বাবা দিবস রোববার ২১ জুন। এ দিনে বাবাদের নানাভাবে শুভেচ্ছা জানানো বা স্মরণ করা হয়। বাবাকে যথাযথ সম্মান ও ভালোবাসা দেওয়াই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য।

বাবাদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন হয় নাকি? বা বিশেষ একটা দিনই শুধু বাবাদের জন্য? এ নিয়ে বিশেষ তর্ক-বিতর্ক রয়েছে। দিবসটি দেশে নতুন হলেও এখন অপরিচিত নয়। বিশ্ব বাবা দিবসে বাবার জন্য নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে।

বাবা দিবসে সাভার স্মৃতিসৌধের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা গণবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বাবার সঙ্গে ঘটা বিস্ময়কর কিছু স্মৃতি, গল্প ও ভাবনা জানতে কথা বলি কয়েকজনের সঙ্গে।

ভাষা যোগাযোগ ও সংস্কৃতি বিভাগের সপ্তম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী আকাশ আহমেদ বলেন, বাবার সঙ্গে খুব একটা স্মৃতি নেই। তিনি ২০১১ সালে নক্ষত্রের ওপারে চলে গেছেন। একেকটি পরিবারের প্রাণ একেকজন বাবা। বাবার স্থান কেউ পূরণ করতে পারে না। বাবা চলে যাওয়ার পর নানান সমস্যা যেন একসঙ্গে সামনে চলে আসে। প্রতিটি কাজে বাবার অভাব অনুভব করেছি। বাবা সন্তানের পরিচয় বহন করেন। তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটিবার বাবার মুখ দেখার জন্য মন আনচান করে। কত দিন বাবা বলে ডাকি না! বাবার চলে যাওয়ার মুহূর্ত আজও ভুলতে পারিনি।’

অণুজীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী সংগীতা মজুমদার। পঞ্চম সেমিস্টারের এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘কেউ জন্মদাতা পিতাকে কষ্ট দিয়ো না। আজ বুঝতে পারি, কেন বাবা সেই ঘর্মাক্ত শার্ট, ভাঙা চশমার ডাঁট, ছেঁড়া স্যান্ডেল বছরের পর বছর পরতেন। পর্দার অন্তরালে কত কষ্ট, কত যন্ত্রণা তাঁরা সহ্য করছেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন তাঁরা। কিন্তু আমরা সন্তানেরা তাঁদের পর্দার সামনে আনতে চাই না। অবহেলিত এই মানুষই তো বাবা। বাবা হলেন বটগাছ। বৃষ্টিতে ভিজে, রোদে পুড়ে সন্তানকে ছায়া দেন। তবুও প্রিয় বাবাকে কখনো বলা হয়নি, “তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা”।’

ফার্মাসি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. সজীবুল ইসলাম বলেন, ‘যাঁর হাতে হাত রেখে, পায়ে পা মিলিয়ে পৃথিবীর বুকে হাঁটতে শিখেছি, তিনি হলেন বাবা। তিনি কান্না করতে পারেন না। তিনি কখনো ভয় পান না। তিনি কলুর বলদের মতো খেটে যান। তাঁকে নিয়ে নতুন কিছু বলার নেই। ভালো থাকুক সব বাবা। বাবা দিবসে বাবাদের শুভেচ্ছা।’

প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মাহাবুবা আক্তার স্নিগ্ধা বলেন, ‘আমার মাথার ওপর ছাদ হলেন আমার বাবা। বাবা আমাকে নিরন্তর আগলে রাখেন। করোনাময় সময়ে সবাই ঘরে, কিন্তু তাঁকে বাইরে যেতে হচ্ছে। কেন যাচ্ছেন? সন্তানের জন্য, নিজ পরিবারের জন্য। ইনিই হলেন বাবা।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাবা এক রহস্য। তাঁকে আমরা বুঝতে পারি না। কিছু বলতেও পারি না। তিনি থাকেন আড়ালে। কষ্ট লুকিয়ে সুখ উপহার দেন বাবা।’

আইন বিভাগের পঞ্চম সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মো. জাকির হোসেন রনি বলেন, ‘বাবার প্রতি ভালোবাসা আমরা প্রকাশ করতে পারি না৷ তাই বাবাদের আজ এই পরিচয়। মাকে সব বলা যায়। বাবাকে কেন জানি সব কথা বলা যায় না। বাবা বটবৃক্ষের ছায়াস্বরূপ। বাবা আমার আদর্শ। বাবা আমার আবেগ, ভালোবাসা। আমার বাবা আমার সুপার হিউম্যান। না বলা এই কথাগুলো বলার সেরা সময় আজ।’

জাকির হোসেন বলেন, ‘গত দুই বছর আগের এই দিনে আমার বাবা টিভি দেখছিলেন। পাশে আমি বসে ছিলাম। টিভিতে নিউজ হচ্ছিল। উপস্থাপক বলছিলেন, আজ বিশ্ব বাবা দিবস। নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। নিউজটি শুনে বাবার দিকে তাকালাম। তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঠিক তখনই বাবা মৃদু কণ্ঠে আমাকে বলতে লাগলেন—বাবা, তোকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন। তুই কখনো বাজে চলাফেরা করবি না, পড়াশোনা ঠিকভাবে কর, তোকে অনেক বড় হতে হবে। আমি মাথা নিচু করে শুনছিলাম। এরপর দেখলাম বাবার চোখে জল টলমল করছে। আমিও বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কেঁদে ফেললাম। আর তখন বাবা আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। তখনই বুঝলাম, বাবার স্নেহভরা একটা স্পর্শ কতটা প্রশান্তির। এর আগে কখনো বাবাকে জড়িয়ে ধরিনি। এই কারণে আমার কাছে বাবা দিবস অন্য দিবসের চেয়ে স্পেশাল। বাবা দিবস অমর হোক।’

একই বিভাগের চতুর্থ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী মঞ্জুরুল মিঠু। তিনি বলেন, ‘বছরের পর বছর সংসারের জন্য গাধার খাটুনি খেটে যাওয়া ব্যক্তিটির নামই তো বাবা। নিজের সাধ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে তিনিই তো সংসারের হাল ধরে রেখেছেন। তবে বাবাদের এই বিসর্জন আমাদের মায়েদের ত্যাগকে অবমূল্যায়ন করছে কি না, সেটাও ভাবার বিষয় হিসেবে রয়ে যায়। বাবাদের রূঢ়তা আমাদের মায়েদের কষ্ট দিচ্ছে কি না, বাবাদের সঙ্গে স্বল্পভাষী আমাদের এ বিষয়ে কথা বলার এখনই সময়। পুরুষতান্ত্রিকতার বেড়াজাল ভেঙে আমাদের বাবারাও “মা” হয়ে উঠুক।’