বাবা তোমার নামে পাবলিক লাইব্রেরি করে দেব

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষক মোহাম্মদ আলী। ছবি: সংগৃহীত
পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে শিক্ষক মোহাম্মদ আলী। ছবি: সংগৃহীত

বাবাকে নিয়ে আমার তেমন কোনো স্মৃতি নেই, তবে অনুভূতি রয়েছে। বাবাকে ধন্যবাদ দিতে পারিনি বা সরিও বলতে পারিনি। কারণ, ভালো-মন্দ কিছু বোঝার বয়স হওয়ার আগেই আমার ৭ বছর বয়সে বাবা হার্ট অ্যাটাকে চলে যান না ফেরার দেশে।

আমার বাবা দাদার বড় ছেলে ছিলেন। তাই ছোট ভাইদের মানুষ করার দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। যথাবিহীত আমার এক চাচা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন, অন্যজন প্যারামেডিক্স চিকিত্সকের চাকরি পেলেন, আরেক জন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হলেন, আবার একজন ফুফু গ্র্যাজুয়েটও হলেন। আমার চাচা-ফুফু সবাই আমাদের বাসায় থাকতেন। মধ্যে আমাদের বাসায় থেকেও এসএসসি পাস করার পর লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত হলেন আমার মা!


আমার বাবা নাটোর গুরুদাসপুরের বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের বোটানি বিভাগের শিক্ষক ছিলেন। সংগত কারণেই তাঁর অগণিত ছাত্রছাত্রী ও গুণগ্রাহী ছিল। বাসা ছিল উপজেলা সদরে। সেই সূত্রে বাসায় অনেক এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকত। বাবা মোহাম্মদ আলী বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এসব ভালোবাসার মানুষ, পরিবার-পরিজন ছেড়ে আমার বাবা ১৯৯০ সালের জুন মাসে কোনো এক বিকেলে চলে গেলেন নক্ষত্রের ওপারে।
আমরা বড় হচ্ছিলাম। বাবার কাছে আমাদের প্রয়োজন যখন শুরু হলো, তখন বাবা পাশে নেই। বাবার শাসন, বাবার আদর, বাবার আর্থিক সাপোর্ট, বাবার বটগাছের মতো ছায়া—সবই প্রয়োজন ছিল। বাবার উপস্থিতিসহ সবকিছু থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। হঠাৎ করে কোথা থেকে কী যেন হয়ে গেল! ছেলের শোকে আমার দাদার শরীরের এক অংশ অবশ হয়ে গেল। আমার অসুস্থ দাদিও বিছানায় পড়ে গেলেন। চাচারা নিজ নিজ পরিবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।


বাবার বেতন বন্ধ। তাঁর কোনো সঞ্চয় ছিল না। আর সঞ্চয় থাকে কীভাবে? বেসরকারি চাকরি। শুধু নিজের বাড়িখানা ছিল আর ছিল কয়েক বিঘা পৈতৃক কৃষিজমি। তখন আমার মায়ের সংগ্রাম শুরু হলো।


দিন থেমে থাকেনি। আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার। আমার বড় এক বোন চিকিত্সক, তিনি প্রবাসী। বড় আরেক বোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এখন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা করছেন। মা কষ্ট করে মানুষের মতো মানুষ করার চেষ্ট করেছেন, এ জন্য সরকারি স্বীকৃতি পেলেন। আমার মা নার্গিস সুলতানা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের জয়িতা অন্বেষণ কার্যক্রমের আওতায় ২০১৭ সালে রাজশাহী বিভাগের সেরা জয়িতা নির্বাচিত হন।


বাবা তুমি ছিলে মানুষ গড়ার কারিগর। তোমার হাতে মানুষ হয়েছে আমাদের উপজেলার অনেক ছাত্রছাত্রী। বাবা তুমি ছিলে আদর্শবান শিক্ষক। আমরা তোমার আদর্শকে বুকে ধারণ করে এগিয়ে চলেছি সামনের পথে। কখনো পিছপা হইনি, কখনো হাল ছাড়িনি, কখনো আশাহত হইনি। বাবা তুমিই ছিলে আমাদের অনুপ্রেরণা। দুঃখ একটাই, তুমি আমাদের সবকিছু দেখে যেতে পারলে না।


১৮ জুন, ২০২০ আমার বাবার মৃত্যুর ৩০ বছর পূর্ণ হলো! বাবা তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল, বলা হলো না। বাবা, তোমাকে নিয়ে আমাদের স্বপ্ন তোমার নামে একটা পাবলিক লাইব্রেরি করে দেব। তুমি যে গ্রামে জন্মেছ, সেই গোটিয়া গ্রামে। নাটোরের সিংড়ার গোটিয়া গ্রামের মানুষ আলোকিত হবে তোমার নামের সেই লাইব্রেরিতে বই পড়ে। তুমি ছিলে শিক্ষার বাতিঘর, তোমার নামের লাইব্রেরিও হবে জ্ঞানচর্চার বাতিঘর।