বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে আমার বাবা দিবস

লেখকের বাবা
লেখকের বাবা

জুন মাসের তৃতীয় রোববার বিশ্বজুড়ে বাবা দিবস হিসেবে পালিত হয়। আজ ২১ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। আজকের দিনে সবাই পরম শ্রদ্ধা আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় স্মরণ করবে নিজের বাবাকে। কেউ বাবাকে নিয়ে কেক কাটবে; কেউ ফুল, নতুন পোশাক বা প্রিয় লেখকের বই উপহার দেবে। কেউবা তার বাবার সঙ্গে শৈশবের স্মৃতি রোমন্থন করে আনন্দ–আড্ডা দেবে। অথচ বুকভরা বিষণ্নতা আজ আমাকে অশ্রুসিক্ত করছে। আজই যে আমার বাবার সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকী!

২০১৩ সালের আজকের দিনে আমার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। জীবনসংগ্রামী বাবা যেদিন তাঁর পরিবারকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে চিরদিনের মতো ইহলোকের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটান, সেদিনই এসে দরজায় কড়া নাড়ল বাবা দিবস! ২০১৩ সালের পর থেকে প্রতিটি ২১ জুন আমার মন বেদনার ঘন কালো মেঘে আচ্ছাদিত হয়।

সূর্যের আলো সেই মেঘের আড়ালে থেকে যায় বলে আমাদের ঘরে সেদিন অন্ধকার থাকে! আজ যখন সবাই তাদের বাবার সঙ্গে বিশেষ সময় কাটাবে, তখন আমি আমার ফোনের গ্যালারিতে থাকা বাবার পাসপোর্ট সাইজের একটি ছবিতে তাকিয়ে থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু ঝরাব নিতান্ত সংগোপনে। কারণ, পরিবারের অন্য কেউ তা দেখলে সে–ও অশ্রু ঝরাবে। হয়তো অন্যরাও আড়ালে একই কাজ করে!

বাবা আমাদের ছয় ভাই, এক বোন আর মাকে রেখে পরপারে যাত্রা করেছিলেন। সবাইকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে নিজের শোবার ঘরটা পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এলাকার মোড়লেরা বাবাকে অনেক পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘সব ছেলেকে পড়াশোনা করানোর সক্ষমতা তোমার নেই। তুমি বরং দু-তিনজনকে কামলা বানাও! বাকি দু-তিনজনকে পড়াশোনা শেখাও।’ সেটাই ছিল আমার বাবার জন্য অনেক সহজ। কিন্তু তিনি একটি সন্তানকেও অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত রাখতে রাজি নন। আমার বড় চার ভাইকে মাধ্যমিক পাস করিয়ে প্রায় একই সময়ে শহরের কলেজগুলোতে ভর্তি করে দিয়েছিলেন তিনি। কোনো সহায়-সম্বল ছাড়া নিতান্ত মনের জোরে জীবনসংগ্রামের সাগরে সাঁতার দিয়েছিলেন তিনি। চরম অর্থকষ্টে নিপতিত হয়ে, ঋণের জালে জর্জরিত হয়েও তিনি কোনো ছেলেকে কলেজের পাঠ থেকে পিছপা হতে দেননি। সব সন্তানকে সমান সুযোগ দিয়ে উপযুক্ত শিক্ষাদানই হলো বাবা হিসেবে তাঁর কাছে পরম কর্তব্য। দারিদ্র্যকে যেন তিনি থোড়াই কেয়ার করেন!

২০০৬ সালের কথা! প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার ইংরেজি পরীক্ষাটা আমার কিছুটা খারাপ হলো! আমি হতাশ! আমার স্যারেরা শুনে আশা ছেড়ে দিলেন। তখনো আমার আরও দুটি পরীক্ষা বাকি। হতাশায় আমি মুষড়ে পড়েছি। খাবারও মুখে ঢুকছে না আমার! তখন বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘বাবা! তোমার এইটুকু খারাপ পরীক্ষা দিয়েই হতাশ হচ্ছ কেন? বাকিরা সেটুকুও পারেনি। তোমার এখনো দুটি পরীক্ষা বাকি আছে। ভালো করে পরীক্ষা দাও, তুমি বৃত্তি পাবেই।’ আমি বাবার আশার বাণী শুনে নতুন স্বপ্ন বুনে পরীক্ষাগুলো দিলাম। আলহামদুলিল্লাহ! ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। এটাই হলো আমার বাবার সাহস জোগানোর ধরন, আমার বাবার মোটিভেশন।

২০০৯ সালের কথা! জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষা দিতে যথারীতি আমাকে উপজেলা সদরে থাকতে হবে কয়েক দিন। আমার বই আর দরকারি জিনিসপত্রের ট্রাংকটা মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে রওনা হচ্ছি। আমার বাবা দৌড়ে এসে ট্রাংকটা কেড়ে নিলেন! আমাকে ধমকে খালি হাত-পায়ে ছেড়ে দিলেন, আর নিজে মাথায় পেতে নিলেন আমার ট্রাংকের বোঝা! এতটুকু কষ্টও তিনি আমায় করতে দেবেন না! কয়েক মাস পর হঠাৎ করে দৌড়ে এসে একদিন তিনি আমার বৃত্তি পাওয়ার খবর শোনালেন! আমি আজও বাবার সেই আনন্দভরা মুখখানি ভুলতে পারি না! সন্তানের সাফল্য একজন বাবাকে কত বেশি সুখী করে, সেদিন কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিলাম।

মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়েছিলাম। পরিবারের চরম দারিদ্র্য আমার কলেজে ভর্তির প্রতিবন্ধক! অথচ বাবা আমাকে ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি করে দিলেন। বাড়ি থেকে যেদিন কলেজের উদ্দেশে রওনা হই, বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি বলে সেদিন বাবা আমার সামনেই কেঁদে দিলেন। বাবার এমন আবেগময় মুহূর্ত আর দেখিনি! আবার কলেজে যাওয়ার পর থাকা-খাওয়া আর প্রাইভেট পড়ার টাকা দিতে বাবা যে কতটা কষ্ট সহ্য করেছেন, তা বুঝতে পারি খানিকটা!

২০১৩ সালে কলেজের প্রথম বর্ষের পরীক্ষা শেষ করে আমি বাড়িতে এসেছিলাম জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে। বাড়িতে আসতে আসতে রাত একটা বেজে গিয়েছিল সেদিন। রাত হয়ে যাওয়ায় আমার সেলিম ভাই আমাকে বাড়িতে নিয়ে যেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। স্ট্যান্ড থেকে কয়েক মিনিট এগোতেই দেখি বাবা দাঁড়িয়ে! আমি রাগ করলাম। বাবাকে বললাম, ‘ভাই তো আমাকে এগিয়ে নিতে এসেছেনই। আপনি আবার কেন এসেছেন?’ বাবা বললেন, ‘তোমাকে নিরাপদে বাড়ি নিয়ে যাওয়া ছাড়া ঘরে আমার মন টিকছে না।’ সেই মায়া আমি সেদিন না বুঝে উল্টো রাগ করেছি। কিন্তু এর মাত্র দুই সপ্তাহ পরেই আমি সেই মায়া বুঝতে পারলাম, যেদিন তিনি আমায় ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। আজ সেই দুঃখভরা দিন, যেদিন নিজের হাতে আমার বাবাকে কবরস্থ করে এসেছিলাম! কি অদ্ভুত! আজই কিনা এল বাবা দিবস!

যেই বাবা তাঁর কর্মস্থল আলিয়া মাদ্রাসায় একটি জিলাপি কিংবা দুটি বিস্কুট কিংবা তিনটি চকলেট পেলেও নিজে না খেয়ে পকেটে পুরে আমাদের ছোট ভাইবোনদের এনে ভাগ করে দিতেন, তিনি আজ ওপারে! আর কেউ তেমন করে আমাকে একটি সন্দেশ এনে হাতে দেয় না! আর পাঁচটি টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে কেউ বলে না, ‘নাও বাবা! চানাচুর খেয়ে এসো।’ বাবার মতো আর কেউ ফোন করে আমায় বলে না, ‘বাবা হোস্টেলের খাবার খেতে পারো তো?’ আমি শহর থেকে বাড়ি ফিরলেই আর কেউ আমার জন্য বেল, তরমুজ কিংবা মিষ্টিআলু কিনতে বাজারে চলে যায় না। আর কেউ অমন করে মাথায় হাত বুলিয়ে আমার রাগ ভাঙিয়ে বলে না, ‘বাবা! এমন করে রাগ করতে নেই। যাহ! ভাত খেয়ে নে।’

বাবা আমাকে যেমন আদর করতেন, তেমন শাসনও করতেন। স্কুল থেকে পালানো আমি প্রথম শ্রেণিতে থাকাকালে বাবার এক থাপ্পড়ের চোটে সেই যে স্কুলে ঢুকেছি, তারপর থেকে জীবনে কোনো দিন পালাইনি। না পড়ার দোষে কিংবা ছোট কোনো অন্যায় করলেও বাবার মার খেয়েছি বহুবার! ঠিক পথে থাকতে ওটা কাজে দিয়েছে। বাবার সেই শাসনে আজও আমি গ্রামে থাকলে বাড়িতে ফিরতে একটুও রাত করি না।

বাবা আমাকে শিখিয়েছেন দারিদ্র্যকে টপকে যেতে, শিখিয়েছেন অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। বাবার শিক্ষা হলো সুশিক্ষায় সমাজকে ও পরিবারকে আলোকিত করা। বাবার শিক্ষা হলো, ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সবাইকে সমান চোখে দেখা। তিনি শিখিয়েছেন, লোকের কটু কথার ভয়ে নিজের সুন্দর কাজগুলো বন্ধ না করতে। বাবার আচরণে ছিল কঠোরতা আর কোমলতার অপূর্ব সমন্বয়!

আজ বাবা দিবস! অথচ বাবা আজ বেঁচে নেই। আজই কিনা তাঁর মৃত্যুর সাত বছর পূর্ণ হলো। প্রয়াত বাবার কথা ও স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। এতটা ভালোবাসি আমার হারানো বাবাকে, অথচ কখনো তাঁকে বলতে পারিনি। এমনকি বাবার সঙ্গে এক ফ্রেমে আমার নিজের একটা ছবি পর্যন্তও তোলা নেই! অথচ তাঁর স্মৃতি আমার হৃদয়পটে আজও ভাস্বর! বাবাকে হারানো অনেকেই আজ পুরোনো সেই স্মৃতিগুলো মনে করে নীরবে চোখ মুছবে। যাদের বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছেন, তারা আজ আমার মতো বলবে, ‘বাবা কত দিন, কত দিন দেখি না তোমায়...’

পৃথিবীর সব বাবাই ভালো থাকুন; আর যাঁরা পরলোকগত হয়েছেন, সেই সব বাবা শান্তিতে থাকুন—এই হোক আজকের বাবা দিবসের প্রত্যাশা।


*শিক্ষার্থী, ফার্মাসি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।