সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

নতুন করোনাভাইরাস সারা বিশ্বেই দাপট দেখিয়ে চলছে। দুই শটিরও বেশি দেশে হানা দিয়েছে ভয়ংকর হয়ে ওঠা এই ভাইরাস। সারা বিশ্বে ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন ৮৮ লাখের বেশি মানুষ। আর এই ভাইরাস থেকে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগ ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে প্রায় সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষের প্রাণ। বাংলাদেশেও এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন ১ হাজার ৪০০–এর বেশি মানুষ।

বৈশ্বিক এই মহামারি বাংলাদেশের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ থাকা সিঙ্গাপুরেও আঘাত হেনেছে। কিন্তু সংক্রমণের বিস্তার রোধে দেশটির নানামুখী ব্যবস্থাপনা এখন অনেকের জন্য অনুকরণীয় হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের নামকরা হাসপাতাল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে ক্লিনিক্যাল ফেলো হিসেবে কাজ করার সুবাদে দেখেছি দেশটির কর্তৃপক্ষ কীভাবে এই সংক্রমণ মোকাবিলায় পদক্ষেপগুলো নিয়েছে। আমার মনে হয়েছে, বাংলাদেশে অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেললেও এখনো সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে পারে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে প্রথম এই রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। পরে গত ১১ ফেব্রুয়ারি এই সংক্রমণকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোভিড-১৯ হিসেবে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ভাইরোলজিস্টরা অবশ্য বলছেন সার্স কভ-২। নতুন এই করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চীনের নববর্ষের (২৫-২৬ জানুয়ারি) পরপর বাড়তে থাকে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সিঙ্গাপুরের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ চীনা। ফলে ওই সময় সিঙ্গাপুর থেকে প্রায় ১০ হাজার মানুষ চীন ভ্রমণ করেন আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার জন্য। এতে বড় ঝুঁকিতে পড়ে যায় সিঙ্গাপুর। তবে সিঙ্গাপুর প্রায় প্রথম থেকেই খুব সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা শুরু করে। দেশটিতে প্রথম কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হয় গত ২৩ জানুয়ারি। তখনই সরকার চীনের হুবেই প্রদেশে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। আর যাঁরা চীন থেকে সিঙ্গাপুরে প্রবেশ করেছিলেন তাঁদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলকভাবে হোম কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা হয়। কারও জ্বর, সর্দি, কাশি থাকলেই কাজে যেতে নিষেধ করা হয় এবং নিজ নিজ জায়গা থেকেই চিকিৎসার জন্য যোগাযোগ করতে বলা হয়। আক্রান্তদের বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। সব সরকারি হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার ঘোষণা দেয় সরকার। তারপরও কিছুসংখ্যক মানুষ তথ্য গোপন করে জ্বর, সর্দি, কাশি নিয়ে অফিস করছিলেন। তখন সরকার ওই সব মানুষদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়। তথ্য গোপনের কারণে অনেককে চাকরিও হারাতে হয়। এমনকি সিঙ্গাপুরের স্থায়ী নাগরিকত্ব এবং নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলের ঘটনাও ঘটে।

প্রথম থেকেই আক্রান্ত ব্যক্তিদের জরুরি প্রয়োজন না হলে বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিতে উৎসাহিত করা হয় সিঙ্গাপুরে। এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে রোগী স্থানান্তরে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। গত ৭ ফেব্রুয়ারি সরকার সিঙ্গাপুরকে ইয়েলো (মৃদু ঝুঁকিপূর্ণ) থেকে অরেঞ্জ (মাঝারি ঝুঁকিপূর্ণ) উন্নীত করে।

আমরা তখন সেখানকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে ই-মেইল পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের চেহারা বদলে গেল। রাতারাতি হাসপাতালের প্রবেশপথে থার্মাল স্ক্যানার বসানো হলো। দর্শনার্থী নিয়ন্ত্রণ করা হলো। সব হাসপাতালের কর্মীদের কাজের রুটিন পরিবর্তন হয়ে গেল। কোভিড-১৯ রোগী ও সন্দেহভাজন রোগীদের জন্য আলাদা চিকিৎসক দল গঠন করা হলো। জরুরি রোগী ছাড়া বহির্বিভাগের বেশির ভাগ রোগীকে দেখার সময় পেছানো হলো। কোভিড রোগীদের ও সন্দেহভাজন কোভিড রোগীদের আলাদা ওয়ার্ডের ব্যবস্থা করা হলো। হাসপাতালের প্রত্যেক কর্মীর জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হলো। হাসপাতালে জরুরি চিকিৎসাসেবা ছাড়া অন্য সব চিকিৎসা স্থগিত করা হলো।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে কাজটি করা হলো সেটি হলো, পর্যাপ্ত পরিমাণ নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হলো।

এরপর দেখা গেল, শ্রমিকদের থাকার ডরমেটরিগুলোতে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। এতে সিঙ্গাপুরে আক্রান্তের সংখ্যাও অনেক বেড়ে যায়। যা তারা সার্কিট ব্রেকারের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আনতে অনেকটাই সক্ষম হয়। সার্কিট ব্রেকার লকডাউনের কাছাকাছি একটি ব্যবস্থা। তবে তারা পরিবহনব্যবস্থা চালু রাখে। কিন্তু ট্রেন ও বাসে কে কোথায় বসবে, তা চিহ্নিত করে দেওয়া হয়। এমনকি স্টেশন বা বাস স্টপেজে কে কোথাও দাঁড়াবে তা–ও ঠিক করে দেওয়া হয়। তবে ১ জুন থেকে সার্কিট ব্রেকার খুলেছে। ধাপে ধাপে সবকিছু খুলছে।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় তখন সরকার প্রত্যেক শ্রমিকের বেতন ও তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করে। তারা ৬০ হাজার শ্রমিকের জন্য সাময়িকভাবে নতুন আবাস্থলেরও পরিকল্পনা করে। সিঙ্গাপুর সরকার দেশটির বিলাসবহুল বিভিন্ন হোটেলের প্রায় ৮৫ হাজার কক্ষ কোয়ারেন্টিন এবং আইসোলেশনের জন্য বরাদ্দ করে। যার পুরো খরচ সরকারই বহন করছে।

নানামুখী ব্যবস্থার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা ১৬ জুন পর্যন্ত ৪৩ হাজার ৯৪৩ জন হলেও এর মধ্যে ৩১ হাজার ১৬৩ জনই সুস্থ হয়ে গেছেন। আর মারা যাওয়ার সংখ্যাটিও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম, ২৬ জন।
সিঙ্গাপুর উন্নত দেশ, জনসংখ্যাও কম। দেশটি চলে প্রচণ্ড নিয়ম-কানুনের মধ্য দিয়ে। সুতরাং বাংলাদেশ সবকিছু সিঙ্গাপুরের মতো করতে পারবে তা বাস্তবসম্মতও নয়, আশাও করা যায় না। তবে সিঙ্গাপুরের আলোকে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট কিছু করার আছে।

প্রথমে সবাইকেই বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। এখানে কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। তবে এ জন্য সবার আগে দরকার সবার জন্য মাস্ক সহজলভ্য করা। ঘন ঘন হাত ধোয়া ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করার মতো স্বাস্থ্যবিধি তো অবশ্যই মানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটি হলো পর্যাপ্ত পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী শনাক্ত করে আলাদা করার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য পরীক্ষা করার সুযোগটি সহজ করতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের একজন মানুষও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। ফলে জেলা ও উপজেলায় পরীক্ষার সুযোগ করার ব্যবস্থা করা উচিত। আর যেহেতু রোগী বাড়ছে, সুতরাং এখন সব হাসপাতালেই কোভিড ও সন্দেহভাজন রোগীদের আলাদা রেখে চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য হাসপাতালের শয্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। এই যুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক চিকিৎসকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এই নতুন করোনাভাইরাস।

এ ছাড়া বয়স্ক ও ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের জরুরি না হলে বাইরে যাওয়া বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি এই রোগ সম্পর্কে সারা দেশে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। নিতে হবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভয় নয়, একমাত্র সচেতনতা ও সতর্কতাই পারে এই রোগকে নিয়ন্ত্রণে ও প্রতিরোধ করতে।

*লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ভাস্কুলার সার্জারি বিভাগ, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ফেলো ন্যাশনাল ইউনিভাসিটি হাসপাতাল, সিঙ্গাপুর