বিশ্বে কিউবার চিকিৎসা উপহার, বাংলাদেশ কী বার্তা পেল

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

বিপ্লবের ফেরিওয়ালা, আমার অন্তরে (অনেকেরই) যাঁর বাস, সেই ডা. চে গুয়েভারাকে (চে চিকিৎসক ছিলেন) পাওয়াটা ছিল ফিদেল কাস্ত্রো ও কিউবান জাতির জন্য সৌভাগ্য। ১৪ জুন ছিল চে গুয়েভারার জন্মদিন। কিউবান বিপ্লব সফল করে চে গুয়েভারা স্বাস্থ্য-চিকিৎসা খাত নতুন করে মানুষের জন্য গড়ে তোলার ফলেই আজ কিউবানরা সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সুচিকিৎসার সুফল পাচ্ছেন। সবচেয়ে বড় আলোচিত ঘটনা, যে কিউবান চিকিৎসাসেবার সুফল পাচ্ছে করোনায় আক্রান্ত ইতালি, জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সসহ ইউরোপ। বলা যায়, এটা কিউবান চিকিৎসার উপহার বিশ্বকে।

আর এদিকে জাফরুল্লাহর চিকিৎসানীতির বা ঔষুধনীতির সুফল পেয়ে নতুন জন্ম ফুলেফেঁপে ওঠা শত শত ওষুধ কোম্পানির। অনেকের মনে আছে, আমার চেয়ে বেশি বয়সীদের একটা চিত্র। গ্লাক্সো, রেকিট অ্যান্ড কোলম্যান, ফাইজারের মতো বিদেশি কোম্পানির কারণে আশি-নব্বইয়ের দশকে তখন দেশি কারও সে রকম পাত্তা ছিল না।

যিনি এইটা বুঝেশুনে দেখলেন যে সামনে ঘোর অন্ধকার, কিছু করা দরকার। সেই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৮২ সালে এইচ এম এরশাদকে বুঝিয়ে দেশে প্রথমবার জাতীয় ঔষধনীতি–স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও পাস করালেন। সুদিন এনে দিলেন যে বিপ্লবী সংস্কারক, সেই ডা. চৌধুরীর বিরুদ্ধে সবাই কেন এককাট্টা!


বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে কি একাত্তরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা জাফরুল্লাহর প্রণীত জাতীয় ঔষধনীতি–স্বাস্থ্যনীতির ড্রাফট কি আর বুড়িগঙ্গায় কেউ ফেলে দেওয়ার সাহস রাখতেন? না। কারণ, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিপ্লবী ও উদ্ভাবক মানুষ। একজন উদ্ভাবক অন্য উদ্ভাবকের সংস্কারের কাজ বাতিল করতে পারেন না। বাতিল করেনও না। আজ জাফরুল্লাহ চৌধুরী এই দেশে চে গুয়েভারার চিকিৎসানীতির ছায়া অনুসরণ করে যা যা করেছেন জনতার জন্য, তা ইতিহাস সোনালি অক্ষরে জয়গানে বিচার করবে। অথচ তাঁর জনবান্ধবনীতি পদ্ধতি চরম জনবিরোধী ভূমিকায় পঁচাত্তর-পরবর্তী সব সরকার, চিকিৎসক সংগঠনগুলোসহ দেশীয় কোম্পানিগুলো আমলে নেননি। কারণ আর কিছুই না। চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ছবি
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ছবি

জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্য দেশে জন্ম নিলে প্রাপ্যটা যথার্থ পেতেন। কিন্তু সেটা আবার জনগণকে বহুগুণে উপহারে ফিরিয়ে দিতেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী সব সরকার আমাদের চিকিৎসার বনিয়াদ বানানোয় সীমাহীন উদাসীনতায় উল্লেখযোগ্য কিছু না করে অন্যায় করেছে। এই মহামারিকালেও এই পন্থা বহাল তবিয়তে আছে।


এটার ফল এখন সবাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। রাত পোহালে ভোর হলেই প্রতিদিন এখন কপালে নতুন নতুন ভাঁজ পড়ছে। সে যা-ই হোক, অনেক সময় ভাবি, পুঁজিবাদী এ ব্যবস্থা ডা. জাফরুল্লাহর বড় ক্ষতি কেন, কী কারণে বাকি রেখেছে এখনো। কারণ, ঢাকার বুকে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল আছে, লিস্ট অনেক লম্বা। নাম বললে শেষ হবে না। আক্ষেপ, সেসব হাসপাতালের মধ্য ভালো একটা জনবান্ধব হাসপাতাল দেশের মানুষের সুলভ চিকিৎসার জন্য তৈরি হলো না।


অথচ গণস্বাস্থ্য বীরের মতো জনতাকে অল্প খরচে সেবা দিচ্ছে বহু বছর। এই কাজে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এই স্বাস্থ্যযোদ্ধাকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। জমি দিয়ে সাহায্য করেছেন জাতির পিতা। তারপর গণস্বাস্থ্য মানুষের সেবা চিকিৎসা দিয়ে চলছে সমাজভিত্তিক পদ্ধতিতে ঢাকা ও বাইরের অজপাড়াগ্রামেও। নিজদের ফার্মাসিউটিক্যালে তৈরি ওষুধ সুলভে এবং নিজেদের গণবিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি চিকিৎসকদের মাধ্যমে। এই মডেল বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। এখন করোনায় কেউ কেউ মারা গেছেন বা সামনে আল্লাহ কাকে নিয়ে যাবেন, তা কেউ বলতে পারেন? তাই এই অছিলায় হলেও জনতার চিকিৎসা পদ্ধতি চালু করা যায়। এখনো সুযোগ আছে আমাদের স্বাস্থ্য-চিকিৎসা পরিকাঠামো ঢেলে সাজানোর, গণমানুষের জন্য। এ স্বপ্ন এখনো দেখি।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

আর কী বলব। এটা করতে না পারলে আপনারা দেখবেন নেপাল, মালদ্বীপ, আফগানিস্তান আগামী পাঁচ বছর পর বাংলাদেশ থেকে রোগী টানবে। বেঁচে থাকলে দেখবেন। কোন চিত্র দেখবেন, তা ভবিষ্যৎ বলে দেবে। নীতি-পলিসি গোল্লায় চলে গেলে, দেশে দেশে উদাসীনতা বেশি হয়ে গেলে, মহামারি এসে শিক্ষা দেয়। চ্যালেঞ্জ করে ভঙ্গুর ব্যবস্থার। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের চেয়ে উত্তম। এই আপ্তবাক্য থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরও ভারত, সিঙ্গাপুর, কিউবা বা ইরানের মতো ভালো সুচিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, হবেই।


করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আগের হিসাব, প্রতিবছর গড়ে ৩৫ লাখ রোগী যান দেশের বাইরে চিকিৎসাসেবা নিতে। বিদেশে রোগী না যাওয়ার জনবান্ধব পদ্ধতি তৈরি করতে হবে। এ জন্য জনবান্ধব সুলভ স্বাস্থ্য-চিকিৎসা নীতির বাস্তবায়ন চাই।

*লেখক: উন্নয়ন বিশ্লেষক ও গবেষক