লকডাউনের দিনগুলোতে যা পাচ্ছি, যা পাচ্ছি না

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

বেঁচে আছি। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যখন দিনের শুরু করতে হয়, তখন সত্যিকার অর্থেই লকডাউনের সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। বেঁচে থাকা যে কত সুন্দর, কত বিশাল সৌভাগ্যের ব্যাপার, তা এই লকডাউন না এলে হয়তো সবাই এত গভীরভাবে অনুভবই করতে পারতাম না। আমরা যেখানে লকডাউন শব্দটিই শুনিনি আগে, সেখানে আজ লকডাউনের সময় তিন মাস পেরিয়ে গেল।

ভাবা যায়? বাড়ির দুরন্ত ছেলেটাও তিন মাস ধরে এক ঘরে বন্দী হয়ে কাটিয়ে দিচ্ছে দিনের পর দিন? আমাদের ভাবনার অতীত অনেক কিছুই দেখতে হচ্ছে আজ। হয়তো সামনেও হবে। আজকের এই অসুস্থ পৃথিবী কবে সুস্থ হবে কে জানে। বাংলার মাটি থেকে করোনাকে জয় করে কবে সবাই প্রাণ খুলে নিশ্চিন্ত মনে বাসা থেকে বের হব, তা–ও জানা নেই। এমনকি এই লেখাগুলো যে লিখে চলেছে, সেই লেখকের বেঁচে থাকাও ভারী অনিশ্চিত! কে জানে কাল নিজের মাঝেও ভাইরাসের বাসা বাঁধার কথা হজম করে যেতে হয় কি না। কত কিছুই তো অনায়াসে হজম করে এতগুলো দিন পার করে ফেললাম।

লকডাউন শব্দটি মাথায় খেলা করলে সঙ্গে সঙ্গেই যে অনুভূতি মনের ভেতর উঁকি দেয়, তা হচ্ছে আবদ্ধতা। শহরের ব্যস্ততার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে চলতে হুট করে একদিন সব থমকে যেতে দেখা। সকাল সকাল ছোট ছেলেটার স্কুলের জন্য উঠবার তাড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া, ভ্যানের ভেতর কচি কচি মুখের আনন্দগুলো ঘরবন্দী হওয়া, নেই নিয়ম করে সকাল বিকেল কোচিং করতে যাবার চিন্তা, নেই ডায়েরি দেখে স্কুলের পরের দিনের রুটিন অনুযায়ী বই গোছানো, নেই আড্ডা, নেই অসংখ্য প্রিয়মুখের দেখা। নেই পাড়ার মসজিদে একসঙ্গে নামাজ পড়তে যাওয়া, নেই চায়ের দোকানে এক কাপ চায়ে চুমুক দিয়ে সারা দিনের ক্লান্তি দূর করা, ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলেটার পাবলিক বাসে ভিড় ঠেলে প্রতিদিন যাতায়াত নেই, কলেজপড়ূয়া মেয়েটার রিকশা ভাড়া বাঁচানো নিয়ে আর মাথাব্যথা নেই। একটি লকডাউনের শুরু এমন কত অজস্র নেইয়ের মাঝে আমাদের ঠেলে দিয়েছে আমরা বুঝবার আগেই।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

অবশ্য শত নেইয়ের মাঝেও কিছু মানুষের ছুটে চলা থামেনি। তাঁরা হচ্ছেন পরিবারের মা-বাবা। পরিবারের দিকে তাকিয়ে ঝুঁকি নিয়ে হলেও খাবার কিংবা ওষুধের ব্যবস্থা করতে বের হতে হচ্ছে বাবাদের। সরকারি অফিসের কিছু ওপরের পর্যায়ে কাজ করেন যাঁরা, তাঁদেরও যেতে হচ্ছে দিনের পর দিন। আর বাসায় থাকা মা? তাঁর তো কাজ আর ছোটাছুটি যেন আরও বেড়েছে। বাসায় মায়ের কাজে সাহায্য করতে আসা মানুষটির হঠাৎ ছুটি হয়ে গেলে এমন না হয়ে উপায় কী? অবশ্য এমন অবস্থায় তাঁকে থাকতে হয়নি। লকডাউনের বেশ কিছু সুন্দর বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে বাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে বাড়ির কাজগুলোতে মায়ের সাহায্য করতে থাকা।

লকডাউনের শুরুটা ছিল খুব অন্য রকম। মনের ভেতর তখনো সেভাবে ভয় জেগে ওঠেনি। দেশের মাঝে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা খুব কম ছিল কি না! যাহোক, তখন হাতে জমা অনেক অনেক কাজ। ভেবে বসেছিলাম, সেগুলো করেই বোধ হয় সময়গুলো কাটবে। কত কত বই হাতের কাছে এসে পড়ে আছে, হাতে নিয়েও পড়া হচ্ছে না। কত কত নাটক আর সিনেমার লিস্ট চোখের সামনে। স্মার্টফোনের জগৎ তো আছেই। বেশ কেটে যাবে সময়! কিন্তু না। নিজের ভেতরে নিজেকে আটকে রাখা যে কতখানি কষ্টের, তা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারলাম। চাইলেই এত সহজে এই জীবনকে নিজের করে নেওয়া যায় না। স্মার্টফোনের পর্দায় প্রিয়মুখগুলোকে কিছু সময়ের জন্য আনা তো যায়, কিন্তু সে আনার সঙ্গে তাদের সামনে বসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়ার অনুভূতিতে যে বিস্তর ফারাক। এই শহরের দালানের ফাঁকে ফাঁকে আকাশের দেখা পাওয়াও দুঃসাধ্য ব্যাপার। এক ঘর থেকে অন্য ঘর। এই তো জীবন এখন!

তবে এই লকডাউন যে শুধু বন্দী অবরুদ্ধ এক নির্মম জীবন দিয়েছে এমন নয়। আছে বেশ কিছু সুন্দর দিকও। জীবনের ব্যস্ততা যেখানে মা–বাবার সঙ্গের সময়গুলো নিষ্ঠুরভাবে কেড়ে নিয়েছিল, এই লকডাউন যেন তা মুঠো ভরে ফিরিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে রাত একসঙ্গে। যেন অনেক দিন পর আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে যে কজন, তাদের বন্ধু হিসেবে আবার কাছে পেয়েছি। কত কথা, কত আড্ডা, কত ভালো খারাপ মুহূর্তের গল্প! তবে সেগুলো অনেক দিন পর এত সময় নিয়ে মা–বাবার সঙ্গে। কোনো ভার্চ্যুয়াল জগতের শব্দের মাঝে খুঁজে পাওয়া সত্তা না কিংবা জীবনে কয়েক মাস ধরে কাছে টেনে ধরা মানুষ না। বরং জন্ম থেকেই গুটি গুটি পায়ে পথচলার শুরু যে মানুষদের হাত ধরে, কথা বলতে শিখা যাদের থেকে, সেই পুরোনো, সুন্দর এবং স্বচ্ছ সম্পর্কগুলোর সঙ্গে।

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

জীবনে খুব অন্য রকম এক রমজান এল। যত দ্রুত এল, তার চেয়েও দ্রুত যেন চলে গেল। এই প্রথম তারাবিহ্‌ থেকে শুরু করে জুমা—সব ওয়াক্তর নামাজ বাসায়। তবে অনেক পরিবারে একসঙ্গে সবাই মিলে জামাতে নামাজ পড়ার মতো অসম্ভব সুন্দর কিছু সময় দিয়ে গেল এই মাস। তত দিনে আমার দিনের রুটিনের নাজেহাল অবস্থা। দিনের শুরু হয় দুপুর বারোটার পর। রাত পেরিয়ে ভোর চারটা কি পাঁচটা। তবু ঘুমানো হয় না। সূর্য ওঠে, আমি ঘুমাই। আমি উঠি, তারপর সূর্য অস্ত যায়। যেন প্রকৃতির সঙ্গে শরীরের বিরাট এক দ্বন্দ্ব। শরীরে জমতে থাকে মেদ আর প্রাণের মাঝে স্পন্দনহীনতা। সারাটা সময় মনের ভেতর হাহাকার। কী যেন নেই, কী যেন নেই! লেখালিখি শুরু করি। লেখার মাঝেই স্বস্তি খুঁজতে থাকি। একের পর এক গল্প সৃষ্টি করে নিজের সময় পার করতে থাকি। ঈদ আসে। জীবনে এমন এক ঈদ আসবে কখনো ভাবিওনি। ঘরের মাঝে সেজেগুজে নিজেরা নিজেরাই পালন করি। এভাবেই আরেক মাসের শেষ।

টিভির নিউজ একপর্যায়ে আতঙ্ক নিয়ে আসে। যে সংখ্যাগুলো একসময় ছিল ২০ কিংবা ৩০ এর ঘরে, করোনায় আক্রান্তের সেই সংখ্যাগুলো পৌঁছে যায় হাজারে। মানুষের মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়। দরিদ্র দেশের অসহায় মানুষদের আর্তনাদ বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে দুর্নীতি। কোথাও কেউ নেই। সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার হাত এত কম! সবাই সতর্ক হতে থাকে। পথগুলো শূন্য হয়। চেনা শহর অচেনা রূপ নিয়ে দেখা দেয়। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। বুকের ভেতর বাজতে থাকে ভয়। দেশের হাসপাতালগুলোতে একের পর এক রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। একেকজন একেক রকম উপদেশ নিয়ে আসতে থাকে সামনে। মাস্ক নিয়ে যেমন মতের পার্থক্য, এই পরিস্থিতিতে করণীয় কাজগুলো নিয়েও তেমনি। কত কত ওষুধের নাম, কত কত উপায়ে করোনা দূর করার কথা কান পর্যন্ত আসতে থাকে। গরিব প্রাণগুলোর কষ্ট বাড়তে থাকে দিন দিন। এর মাঝেই বাঁচা শিখে যাই সবাই।

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

বেশ কিছু প্রাপ্তি তৈরি হয়। যে ছেলে কিংবা মেয়ে জীবনেও রান্নাঘরে ঢোকেনি, সেও এই লকডাউনে একের পর এক রেসিপি তৈরি করে রান্না শিখে ফেলে। আমি নিজেও শুরু করে ফেলি রান্না। সত্যি বলতে লকডাউনের সবচেয়ে সুন্দর দিক মনে হয় মুক্ত এক মন নিয়ে নিজের মতো কাজ করে যেতে পারা। বাঁধাধরা শিক্ষাব্যবস্থা যেখানে প্রতিটা হৃদয়ের মাঝে শখগুলোকে চাপা দিয়ে রাখে, সবাই অসুস্থ দৌড়ের মাঝে ছুটে যেতে থাকে নিজের সুপ্ত ইচ্ছাগুলোকে ছুড়ে ফেলে, সেখানে এই লকডাউন যেন এনে দেয় আত্মার মুক্তি। শরীর যদিও এক ঘরের মাঝে বন্দী, আত্মা পায় নিজের মতো করে কিছু একটা করে এগিয়ে যাবার সুযোগ। কেউ কেউ গান নিয়ে, কেউ বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আবার কেউ তুলি আর কালি নিয়ে লেগে পড়ে নিজের পছন্দের কাজগুলোতে। অসম্ভব সুন্দর গায়ক, গায়িকার দেখা মিলে যাদের এত দিন দেখা সম্ভব হয়নি, দেখা মেলে লুকোনো শিল্পীদের। লকডাউন আর কিছু দিক বা না দিক, এই প্রতিভাগুলোকে সামনে এনে ধরেছে।

জানি না এই পরিস্থিতির শেষ কোথায়। করোনা নামক দুঃস্বপ্নের এই দিনগুলো কাটবে কবে, কবে মুক্ত প্রাণ নিয়ে ক্যাম্পাসে ফেরা হবে। আবার বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের কাপে উঠবে কথার ঝড়, আবার ক্লাসরুমে হবে পাগলামি, গিটার হাতে চিৎকার করে প্রাণগুলো খেলা করে উঠবে। জানি না। তবে আশা রাখি সুদিনের। ভালো থাকুক সবাই। সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। লকডাউন মঙ্গলবার্তা নিয়ে আসুক একদিন।

* শিক্ষার্থী: ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, আইইউটি। [email protected]