করোনাকালে ব্যাংকের ব্যয় সংকোচন কৌশল কেমন হবে

বর্তমান করোনাকালীন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে আয় বাড়ানোটা অনেক দুঃসাধ্য বিষয়। আগের আয় ধরে রাখাটাও সম্ভব হচ্ছে না অধিকাংশ শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষে। তবে আপৎকালীন এই সময়ে টিকে থাকাই মূল লক্ষ্য। তাই এই সময়ে মুনাফা অত্যাবশ্যক না হলেও ব্রেক-ইভেনে থাকাটা জরুরি। আর ব্রেক-ইভেনে থাকতে হলে আয় ও ব্যয় সমান হতে হবে। কিন্তু বর্তমান সময়ে খরচের অঙ্ক স্থির রেখে আয়ের অঙ্ক যেভাবে ছোট হয়ে আসছে, সেখানে ব্রেক-ইভেনে থাকাটাও সম্ভব হবে না অনেক শিল্প ও ব্যবসায়ের জন্যই। তাই ব্যয় সংকোচনের বিকল্প নেই এই মুহূর্তে। ব্যাংকের জন্যও এখন এটাই মূল চ্যালেঞ্জ।

ব্যয় সংকোচনের কথা এলে প্রথমেই আসবে ব্যয়ের খাত প্রসঙ্গ। আমাদের দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি বেসরকারি ব্যাংকের ২০১৮ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী থেকে জানা যায়, ব্যাংকটির মোট খরচের ৫৩ শতাংশ হচ্ছে আমানতের সুদ, পরিচালন ব্যয় ২৭ শতাংশ, ঋণের বিপরীতে প্রভিশন খরচ ৯ শতাংশ এবং কর বাবদ খরচ ১১ শতাংশ। অর্থাৎ ব্যয়ের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে আমানতের সুদ এবং দ্বিতীয় অবস্থানে পরিচালন ব্যয়। তাহলে অঙ্ক সহজ হয়ে গেল—আমানতের সুদহার এবং পরিচালন ব্যয় কমিয়ে দিলে সহজেই ব্যাংকের খরচ কমিয়ে আনা সম্ভব। কারণ, এ দুটি খরচে ব্যাংক নিজে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ আছে। প্রভিশন এবং কর খরচ সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণাধীন।

কিন্তু এ অঙ্কটি কষা যত সহজ, এর বাস্তবায়ন ততটা সহজ নয়। কারণ আমানতকারীরা ব্যাংকের কাছে সুদ পায় বলেই আমানত রাখেন। ব্যাংক সুদ দিবে না বা সুদের হার ইচ্ছেমতো কমিয়ে দিবে, আর এরপরও আমানতকারীরা ওই ব্যাংকের কাছেই টাকা রাখবে—এমনটা ভাবার অবকাশ নেই। আমানতকারীদের সঙ্গে ব্যাংক চুক্তিবদ্ধ। তাই বিদ্যমান আমানতের মেয়াদকালে এর সুদহার কমানোর কোনো সুযোগ নেই ব্যাংকের কাছে। আর বর্তমানে নয়-ছয় সুদহার বাস্তবায়নের পর নতুন আমানতের সুদহার আরও কমানোর আপাতত আর কোনো পথও খোলা নেই।

তাহলে খরচ কমানোর দ্বিতীয় বৃহত্তর খাত হচ্ছে পরিচালন ব্যয় কমানো। তবে ওপরে বর্ণিত ব্যাংকটির পরিচালন ব্যয়ের ৭৩ শতাংশই হচ্ছে কর্মীদের বেতন-ভাতা। তাহলে খরচ কমাতে তথা মুনাফায় থাকতে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোই কি একমাত্র উপায়? দু-একটি ব্যাংক ইতিমধ্যে তাদের কর্মীদের বেতন কমানো এবং ইনক্রিমেন্ট ও বোনাস বাতিলের ঘোষণাও দিয়ে ফেলেছে। বিএবির পক্ষ থেকেও এমন সুপারিশ এসেছে।

কিন্তু আমার মতে, মুনাফায় থাকার কৌশল হিসেবে কর্মীদের বেতন কমানোটা হবে মাথাব্যথায় মাথা কেটে ফেলার শামিল। এটাও করা যেত, যদি ঋণের সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম কমত, অর্থাৎ যদি ব্যাংককর্মীদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ত তাহলে। কিন্তু দুই মাস অতিবাহিত হলেও ঋণের সুদহার কমার কোনো প্রভাব বাজারে নেই। তাই কর্মীদের বেতন কমানো হবে কর্মীদের দুর্বিষহ জীবনযাপনে বাধ্য করার নামান্তর।

তা ছাড়া হাজার কোটি টাকা মুনাফা করা ব্যাংকগুলো করোনাকালেও যদি সেই আগের মুনাফাই হাসিল করতে চায়, সেটা হবে খুবই অবিবেচনাপ্রসূত। আর সেটা যদি হয় কর্মীদের বেতন কমিয়ে, তাহলে তা হবে অগ্রহণযোগ্য এবং অমানবিক। কারণ, ব্যাংকের মালিকদের আর্থিক অবস্থা নিশ্চয় ব্যাংককর্মীদের মতো দুর্বল নয়। একজন ব্যাংককর্মীর মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা কমে গেলে, তাঁর জীবনমানে বিপর্যয় নেমে আসবে, কিন্তু অনেক ব্যাংকমালিকের ৫–১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান হলেও তিনি তা সামলে নেওয়ার মতো সামর্থ্য রাখেন। আর এই মুহূর্তে এটাই প্রয়োজন। ছোটদের এই মুহূর্তে বড়দের কাছ থেকে বটবৃক্ষের ছায়া প্রয়োজন। তাই ব্যাংকের মালিকদের কাছ থেকে কর্মীদের প্রতি উদারতা এবং মানবিকতাপূর্ণ আচরণই কাম্য। এরপরও কোনো ব্যাংক যদি অস্তিত্বসংকটে পড়বে বলে মনে করে, তাহলে কর্মীদের বেতন কমানো ছাড়া হয়তো আর কোনো উপায়ান্তর থাকবে না। তবে যদি এটা করতেই হয়, তাহলে এটা হতে হবে সর্বশেষ অস্ত্র।

তাহলে আমানতের সুদ ও কর্মীদের বেতন কমানো ছাড়া ব্যয় সংকোচনের উপায় কী? হ্যাঁ, এরপরও উপায় আছে। আর তা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে অন্যান্য পরিচালন খরচ কমানোয় মনোযোগী হওয়া এবং কিছু বিষয়ে কুশলী হওয়া। এখানে এক লাফে যদিও ৪০-৫০ শতাংশ খরচ কমিয়ে ফেলা সম্ভব নয়, তবুও কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধনের পাশাপাশি ব্যাংকাররা তাঁদের দৈনন্দিন কাজে একটু মনোযোগী এবং দায়িত্বশীল হলে ১০ থেকে ১৫ শতাংশ খরচ প্রাথমিকভাবেই কমিয়ে আনা সম্ভব বলেই মনে করি।

বিদ্যুৎ খরচে সাশ্রয়ী হওয়া
দিনের বেলায় অফিসের অভ্যন্তরে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো প্রবেশের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে অল্পসংখ্যক বাল্ব জ্বালালে বিদ্যুৎ খরচ অন্তত ১৫-২০ শতাংশ কমানো সম্ভব হবে। সাধারণ বাল্ব ব্যবহার না করে বিদ্যুৎসাশ্রয়ী বাল্ব ব্যবহার করতে হবে। আগে আমার অফিস ফ্লোরে দিনের বেলায় যেখানে ১৫ থেকে ২০টি বালব জ্বালানো হতো, এখন সেখানে মাত্র ৫টি বাল্ব দিয়েই আমার গ্রাহকসেবা দিচ্ছি। এতে শাখার অভ্যন্তরে চোখধাঁধানো আলোকসজ্জা চোখে না পড়লেও গ্রাহকসেবায় কোনো বিঘ্ন কিন্তু ঘটছে না।

প্রয়োজনে ২০০৯ সালের মতো করে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে এনে দিনের আলো বেশি ব্যবহার করা যেতে পারে। বাথরুম থেকে বের হয়ে বৈদ্যুতিক সুইচ বন্ধ করার অভ্যাস নেই অনেকেরই। নিজের বাসা-বাড়িতে করলেও আমরা অনেকেই নিজের অফিসের বাথরুম থেকে বের হয়ে সুইচ বন্ধ করি না। তাই বাথরুমে সেন্সরযুক্ত বাল্ব লাগানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে—বাথরুম ব্যবহারকারী বাথরুমে ঢুকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাল্ব জ্বলবে এবং বাথরুম থেকে বের হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বন্ধ হয়ে যাবে। অফিস ত্যাগের আগেও নিজের ডেস্কের বৈদ্যুতিক সুইচগুলো বন্ধ করতে ভুলে যাই আমরা। শাখার বাইরে সাইনবোর্ডের লাইটগুলো সারা রাত না জ্বালিয়ে রাত আটটার পর বন্ধ করে ফেলতে হবে।

এসি ব্যবহারে মিতব্যয়ী
বিদ্যুৎ খরচের দুই-তৃতীয়াংশ খরচই হয় এসি চালানোর জন্য। তাই এসির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি এর অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার রোধ করতে হবে। যেমন ম্যানেজার সাহেব ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় বা মার্কেটিং ও ক্লায়েন্ট ভিজিট করতে বের হলে একটু খেয়াল করে এসির সুইচটি বন্ধ করে যাবেন। গরমের দিনেও স্যুট-ব্লেজার পরে অফিসে এসে এসি ছেড়ে রাখার বিলাসিতা বর্জন করতে হবে। এসিগুলো সারাক্ষণ চালিয়ে শাখার অভ্যন্তরে শীতল বাষ্পের ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে কিছু সময় পরপর এসিগুলোকে নির্দিষ্ট বিরতিতে চালানো যেতে পারে।

পেপারলেস ব্যাংকিং
ব্যাংকের স্টেশনারি খরচের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই খরচ হয় ঋণপ্রস্তাব ও বিভিন্ন রিটার্ন ও বিবরণী প্রিন্ট করতে। তাই পুরোপুরি ডিজিটাল ঋণপ্রস্তাব ও রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা চালু করা গেলে প্রিন্টিং ও স্টেশনারি খরচ এক–তৃতীয়াংশে নেমে আসবে। একই সঙ্গে সাধারণ ও প্রয়োজনীয় ছোটখাটো করেসপন্ডেন্স ই–মেইলে সেরে নিতে হবে। এতে কুরিয়ার খরচও সাশ্রয় হবে। অতিপ্রয়োজনীয় না হলে কোনো ই–মেইল প্রিন্ট দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ক্রমানুসারে একের পর এক সার্কুলার প্রিন্ট করে নথিভুক্ত না করলে অডিট আপত্তি উত্থাপিত হয়। ফলে কেউ না পড়লেও সার্কুলারটি প্রিন্ট দিয়ে নথিতে রাখতে হয়। এতেও অনেক কাগজ খরচ হয়। এ ধারণা থেকে বেরিয়ে সব সার্কুলার ব্যাংকের ওয়েবসাইট বা অভ্যন্তরীণ লিংকে আপলোড করে দিয়ে সবার জন্য অ্যাক্সেসিবল রাখতে হবে। বড় বা একাধিক পেজের কোনো ডকুমেন্ট প্রিন্ট দিলে উভয় পেজে প্রিন্ট দিতে হবে।

সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি রোধে সচেষ্ট হওয়া
সামান্য অসতর্কতার জন্য ঝড়বৃষ্টির দিনে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, বজ্রপাত ইত্যাদির কারণে কম্পিউটার, ইউপিএস, টেলিভিশন, ফ্রিজ ইত্যাদি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে মেরামত বা নতুন সম্পদ ক্রয়ে আবারও অর্থ খরচ করতে হয় ব্যাংককে। তাই এই ক্ষতি রোধে ঝড়বৃষ্টির দিনে প্রতিদিন অফিস শেষে বৈদ্যুতিক সুইচ অফ করে অফিস ত্যাগ করতে হবে। প্রতিটি শাখায় এবং অফিসে বজ্রপাতনিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

কর্মীদের প্রডাক্টিভিটি বাড়ানো
অফিস সময়ে কর্মীদের অলস সময় না কাটাতে দিয়ে তাঁদের যথাসম্ভব কাজে অ্যানগেজড রাখতে পারলে তাঁদের প্রডাক্টিভিটি বাড়বে। অমুকজন নেই বলে তাঁর কাজটি ফেলে রাখা যাবে না। নিজের হাতে কাজ না থাকলে ব্যস্ত আরেক সহকর্মীকে সহায়তা করতে হবে। এ জন্য কর্মীদের মধ্যে সুষমভাবে দায়িত্ব বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

মানবসম্পদের পোস্টিং পুনর্বিন্যাস
উপরিউক্ত ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮ সালে তার প্রতি কর্মীর বেতন-বোনাস বাবদ গড় খরচ প্রায় ১২ লাখ টাকা। তাই ১০০ জন কর্মী নিয়োগের অর্থ হচ্ছে, এক বছরে ব্যাংকের ১২ কোটি টাকা খরচ বৃদ্ধি পাওয়া। প্রয়োজনে লোকবল নিয়োগ করতে হবে, ঠিক আছে। তবে ব্যাংকের ক্ষেত্রে এটাও শোনা যায়, কোনো কোনো শাখায় উদ্বৃত্ত কর্মী পোস্টিং করা আছে। তাই আপৎকালীন নতুন নিয়োগ সীমিত করে যেসব শাখায় উদ্বৃত্ত কর্মী আছে, সেখান থেকে লোকবল–সংকটে থাকা শাখায় লোকবল সরবরাহ করলে এতে মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহার হবে এবং নতুন নিয়োগ না দেওয়ার কারণে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যাংকের ভালো টাকা সাশ্রয় হবে।

ডায়েরি-ক্যালেন্ডারের খরচ এক–তৃতীয়াংশে নামানো
নতুন বছর লক্ষ্য করে ডায়েরি ও ক্যালেন্ডার ছাপানোর সংখ্যা কমানোর পাশাপাশি প্রতিটির খরচ কমানোয় মনোযোগী হতে হবে। ডায়েরির কাগজের মান (যেমন অনেক ভারী ও মোটা কাগজ ব্যবহার না করে পাতলা কাগজ ব্যবহার করা) কিছুটা কমিয়ে এবং ক্যালেন্ডারের উভয় পাতায় প্রিন্ট ও এক পাতায় চার মাসের তারিখ উল্লেখ করলে ক্যালেন্ডার খরচ এক–তৃতীয়াংশে নামানো সম্ভব হবে। ক্যালেন্ডারের মতো ডায়েরি অতটা প্রয়োজনীয় বলে আমার মনে হয় না। অনেকেই ৩৬৫ দিনের মধ্যে ৩০ দিনও ডায়েরিতে লিখেন কি না সন্দেহ আছে। এ জন্য ডায়েরি প্রিন্ট একেবারে বাদ দেওয়া যেতে পারে, অথবা আগে এক লাখ ডায়েরি প্রিন্ট করে থাকলে সেখানে এ সংখ্যাটি ১০ হাজারে নামিয়ে আনা যেতে পারে।

ভার্চ্যুয়াল বিজনেস মিটিং, কনফারেন্স ও এজিএম
বছরে দু-তিনটি বিজনেস মিটিং বা কনফারেন্স না করে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ক্লাস্টারভিত্তিক বিজনেস মিটিং বা কনফারেন্স করলে প্রতিটি ব্যাংক হোটেল বিল, কর্মীদের আপ্যায়ন ও টিএ-ডিএ বিল বাবদ বছরে কিছু অর্থ সাশ্রয় করতে পারবে। তা ছাড়া সম্প্রতি একটি ব্যাংককে তাদের এজিএমও ভার্চ্যুয়ালি করতে দেখা গেছে, যা এ সময়ে ভালো উদ্যোগ।

বিদেশি ট্যুর ও ট্রেনিং বাতিল করা
টিএ-ডিএর একটি বড় অংশ খরচ হয় ট্রেনিং ও ট্যুর বাবদ। উল্লিখিত ব্যাংকটি ২০১৮ সালে টিএ-ডিএ খরচ বাবদ ২২ কোটি টাকা খরচ করেছে। তাই বিদেশি ট্যুর ও প্রশিক্ষণ (ট্রেনিং) বাতিল করে ভার্চ্যুয়াল পদ্ধতিতে স্থানীয় ট্রেনিংয়ের ওপর জোর দেওয়া যেতে পারে। তা ছাড়া ব্যবস্থাপক (ম্যানেজার) বা অফিস প্রধানদের মাধ্যমেই তাঁদের অধীন কর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

ডিজিটাল আর্থিক প্রতিবেদন
বছরান্তে এজিএমকে লক্ষ্য করে স্টেকহোল্ডারদের দেওয়ার জন্য উন্নত মুদ্রণে ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনের কয়েক হাজার কপি প্রিন্ট করা হয়। এ প্রতিবেদনের পাতা উল্টে যাওয়া ছাড়া সব পাতা পড়ে দেখে খুব কমসংখ্যক ব্যক্তিই। তাই এসব আর্থিক প্রতিবেদন মোটা বই আকারে প্রিন্ট না করে এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশ না করে ডিজিটাল কন্টেন্ট আকারে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আপলোড করার পাশাপাশি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে স্টেকহোল্ডারদের ই–মেইলে পাঠিয়ে দিলে কোটি টাকা সাশ্রয় হবে ব্যাংকের। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত হতে পারে।

প্রডাক্টভিত্তিক আলাদা হিসাব ফরম
বাংলাদেশ ব্যাংক চার ধরনের হিসাব ফরম অনুমোদন করেছে—ব্যক্তিক হিসাব, প্রাতিষ্ঠানিক হিসাব, সরকারি/আধা সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের হিসাব, স্থায়ী আমানত/সঞ্চয়ী স্কিম/বিশেষ স্কিম হিসাব। চতুর্থ প্রডাক্ট ক্যাটাগরিতে প্রতিটি ব্যাংকের ১০ থেকে ১৫ রকমের প্রডাক্ট থাকে। একটি হিসাব ফরমে ১৫ রকমের প্রডাক্ট সংযুক্ত থাকলেও হিসাব খোলা হয় কেবল একটি প্রডাক্টের। এতে করে বাকি ১৪টি প্রডাক্টের জন্য বরাদ্দকৃত পাতার অপচয় হয়। তাই ব্যাংকের প্রতিটি প্রডাক্টের জন্যই আলাদা হিসাব ফরম থাকলে হিসাব ফরমের খরচও অর্ধেক কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ই-কেওয়াইসি বাস্তবায়নে ইস্টার্ন ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকের মতো ই-হিসাব চালু করা গেলে এ খরচ অনেক কমে যাবে।

আপ্যায়ন খরচে সাশ্রয়
বর্তমানে করোনাকালীন গ্রাহক আপ্যায়ন এমনিতেই কমে গেছে। তা ছাড়া স্বাস্থ্যবিধি বিবেচনায় গ্রাহকেরাও ব্যাংক থেকে এখন আর চা-কফি প্রত্যাশা করেন না। তাই আপ্যায়ন খরচ স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। এরপরও আগামী দিনগুলোতে এ খরচে যতটা সম্ভব কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম–নির্ভর বিজ্ঞাপন প্রচার
বর্তমানে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে কিছুক্ষণ পরপরই কয়েকটি মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সেবা প্রদানকারী সংস্থার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। এতে সংস্থাগুলোর পরিচালন ব্যয় যেমন বেড়ে যায়, তেমনি গ্রাহকদের লেনদেন খরচও বেড়ে যায়। বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম (ফেসবুক) বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিনা খরচে বা নামমাত্র খরচে কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব। তাই টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়া বিজ্ঞাপন কমিয়ে ব্যাংকের নিজস্ব ফ্যান পেজের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন প্রচারে মনোযোগী হওয়া উচিত।

নতুন শাখা না বাড়ানো
আপাতত নতুন শাখা বা উপশাখা না খুলে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে মনোযোগী হওয়া যেতে পারে। এতে নতুন শাখা খোলার মোটা খরচ এবং কয়েক বছর নতুন শাখার লোকসান টানার হাত থেকে রেহাই পেতে পারে ব্যাংক।

ডিজিটাল ব্যাংকিং এবং সেবা প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের অংশগ্রহণ বাড়ানো
সেবা গ্রহণের প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের অংশগ্রহণ বাড়ানো গেলে ব্যাংকারের অনেকটাই সময় সাশ্রয় হয়। এতে করে ব্যাংকের লোকবলের প্রয়োজনীয়তাও কমে আসবে। যেমন গ্রাহক নিজে যদি নিজের হিসাব ফরম পূরণ ও খুলতে পারেন, নিজেই যদি পে–অর্ডার আবেদন ফরম পূরণ করতে পারেন এবং সর্বোপরি ব্যাংকারের সাহায্য ব্যতিরেকেই ব্যাংকের অ্যাপ ব্যবহার করে ইন্টারনেট ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে সব লেনদেন করতে পারেন, তাহলে ব্যাংকের লোকবলের প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। তাই প্রতিটি ব্যাংকেই গ্রাহকবান্ধব মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ব্যাংকিং–ব্যবস্থা দ্রুত চালু করে গ্রাহকদের মধ্যে ব্যাংকিং লেনদেন বিষয়ে জ্ঞান ও সচেতনতা বাড়ানোয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

নষ্ট, পুরোনো ও অব্যবহৃত সম্পদ বিক্রয়
ব্যাংকের অনেক কম্পিউটার, আসবাব রয়েছে, যা আংশিক অকেজো হয়ে দিনের পর দিন স্টোর রুমে পড়ে থাকে। এগুলোকে সহজ পদ্ধতিতে বিক্রয় করার ব্যবস্থা করলে ব্যাংকের কিছু টাকা আয় খাতে জমা হবে।

এ কৌশলগুলো অবলম্বনেও যদি কোনো ব্যাংক ইতিবাচক ফল না পায়, তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে তাকে আমানতের সুদহারে হাত দিতে হবে। কিছু ব্যাংক হয়তো স্কিম আমানতে এক-দেড় শতাংশ সুদ এখনই কমাতে পারবে। তবে যেসব আমানতের সুদহার ইতিমধ্যেই ৬ শতাংশে নেমে এসেছে, সেখানে হাত দিতে গেলে অন্যান্য ব্যাংকের গতিপ্রকৃতি অবলোকন করতে হবে। তা না হলে আমানত বেরিয়ে যাবে এবং ব্যাংক দীর্ঘমেয়াদি তারল্যসংকটে পড়বে।

অন্যদিকে কর্মীদের বেতন-ভাতা কমানোর অগ্রিম চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে। এতে খরচ কমলেও কর্মীদের মনোবলে ভাটা পড়বে এবং ব্যাংকের আয় উৎসারী ব্যবসায় কর্মীরা নিজেদের সংশ্লিষ্ট করবে না। ফলে ব্যাংকের আয়ে অধোগতি আসবে। অন্তত এ বছর এমন কিছু চিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করি না। এমন পদক্ষেপ নেওয়ার আগে ব্যাংক নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংকের এবং সরকারের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারে। যেমন ঋণের প্রভিশনে ছাড় চাইতে পারে, করপোরেট ট্যাক্সে ছাড় এবং পরিশোধে সময় চাইতে পারে।

*ব্যাংকার