লিন্ডসের আত্মজীবনী, 'সিলেট থ্যাকারে' এবং উপনিবেশে সিলেট

সিলেটে কোম্পানির শাসন। ছবি: সংগৃহীত
সিলেটে কোম্পানির শাসন। ছবি: সংগৃহীত

‘...আশাতীত সাফল্য নিয়ে কলকাতা থেকে সিলেট ফিরে এলাম। ব্যবসায়ের বিস্তৃত ক্ষেত্র সম্পর্কে আনন্দের সঙ্গে এবার ভাবতে বসলাম। রেসিডেন্ট হিসেবে বছরে আমার বেতন পাঁচ শ পাউন্ডের বেশি নয়। তাই ভাগ্য ফেরাতে হলে পরিশ্রমের বিকল্প নেই। ...সিলেটের পাহাড়সংলগ্ন এলাকা অন্য রকম। উঁচু ও সমতল ভূমি নিয়ে গঠিত। আখ, তুলাসহ অনেক মূল্যবান শস্য উৎপন্ন হয়। উঁচু এলাকায় আরও সম্পদ আছে, যা উদ্যমী ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাহাড়-পর্বতে আছে দামি কাঠ। এতে নৌকা ও জাহাজ নির্মাণ করা যায়। আরও আছে উন্নতমানের লোহা, যা এখানকার লোকজন প্রায় জানে না। ...প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য আছে এখানে। পাহাড়ে পড়ে আছে চুনার অফুরন্ত ভান্ডার। নদীর ভাটিতে আছে চুনা পোড়ানোর উপযোগী প্রচুর জ্বালানি। এ সম্পর্কে বিস্তারিত বলব এজন্য যে এগুলোই আমার পরিকল্পিত বাণিজ্যের মুনাফার বড় উৎস হয়ে ওঠে। বলা যায় এসব পণ্যের ব্যবসাই আমার সৌভাগ্য নিশ্চিত করে। ...’


সিলেটে এসে নিজের ভাগ্যকে কীভাবে গড়ে নিয়েছেন এই উপমহাদেশে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনকালে, তারই কাহিনি বলতে গিয়ে রবার্ট লিন্ডসে (১৭৫৪-১৮৩৬) তাঁর আত্মজীবনীতে এ রকমই লিখেছেন। তৎকালীন সিলেট নিয়ে আরও অনেক কথাই তাঁর বইয়ে আছে। তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিযুক্ত সিলেটের রেসিডেন্ট তথা ডেপুটি কালেক্টর। সিলেটে তাঁর কার্যকাল এবং অবস্থানের সময়কাল ছিল প্রায় ১২ বছর। ১৭৭৮ থেকে ১৭৮৯ সাল পর্যন্ত।

লিন্ডসের মূল বইয়ের টাইটেল পেজ।
লিন্ডসের মূল বইয়ের টাইটেল পেজ।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই উপমহাদেশে প্রথমে এসেছিল ব্যবসা করবে বলে। কিন্তু তাদের আসল মতলব ছিল অন্য। তাই বহুজাতিক কোম্পানির ছদ্মবেশে এসে তারা নিজেদের উপনিবেশ শক্তিতে রূপান্তর করেছিল।


মোগল সম্রাট শাহজাহানের কাছ থেকে তারা ১৬৩৪ সালে বাংলায় ব্যবসা করার অনুমতি লাভ করে। পরবর্তীকালে তারা আরও সুযোগ সুবিধা পেতে থাকে এবং একসময় বিভিন্ন কূটকৌশল আর ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলাতে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে কার্যত বাংলার ক্ষমতা দখল করে বসে। পলাশী যুদ্ধের আট বছর পর ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার আর উড়িষ্যার দেওয়ানি সনদ তথা রাজস্ব আদায়ের অধিকারও লাভ করে। আর ওই সময়ই সিলেট ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে।


কোম্পানি প্রথম দিকে তাদের ঢাকার কাউন্সিলকে সিলেটের শাসনভারের দায়িত্ব দিয়েছিল। কিন্তু এত দূর থেকে শাসনভার ভালোভাবে চালানো সম্ভব হয়নি। আর তাই ১৭৭১ সালে কোম্পানি সিলেটে একজন শাসনকর্তা নিয়োগের কথা চিন্তা করে। ১৭৭২ সালে তারা উইলিয়াম মাইকপিস থ্যাকারে-কে সিলেটের প্রথম ইংরেজ ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে নিয়োগ করে। থ্যাকারে সিলেটের ডেপুটি কালেক্টর ছিলেন ১৭৭২ থেকে ১৭৭৫ সাল পর্যন্ত। আর রবার্ট লিন্ডসে সিলেটের ডেপুটি কালেক্টরের দায়িত্ব পান ১৭৭৮ সালে। তাঁরা ছাড়াও কয়েকজন ইংরেজ কালেক্টর হিসেবে এসেছিলেন।


লিন্ডসে দায়িত্ব শেষ করে ইংল্যান্ড ফিরে যান ১৭৮৯ সালে। ফিরে যাওয়ার প্রায় ২০ বছর পর ১৮২১ সালে নিজের আত্মজীবনী লিখেন। ১৮৪০ সালে তাঁর এই আত্মজীবনী প্রথম প্রকাশিত হয় ‘ওরিয়েন্টাল মিসেলিনিয়াস’ নামের একটি বিশাল বইয়ে ‘অ্যানেকডটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ’ নামে। এই আত্মজীবনীর সিংহভাগজুড়ে রয়েছে তাঁর সিলেট জীবনের কাহিনি।


থ্যাকারে ভারত ছাড়েন ১৭৭৭ সালে। তাঁর জীবন নিয়ে ফ্রান্সিস বি ব্রাডলি বার্ট ‘সিলেট থ্যাকারে’ নামে একটি বই লেখেন। বইটি ১৯১১ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এই ফ্রান্সিস বি ব্রাডলি বার্টও ছিলেন একজন ব্রিটিশ উপনিবেশ কর্মকর্তা। ১৮৯৬ সালে তিনি ভারতে আসেন। সহকারী মাজিস্ট্রেট এবং কালেক্টর হিসেবে তৎকালীন বেঙ্গল প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ সময়ই মূলত তিনি থ্যাকারে সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য জানতে পারেন এবং কোম্পানির বিভিন্ন রেকর্ড ও দলিল-দস্তাবেজ ঘেঁটে তাঁকে নিয়ে বই লেখেন। এ বইয়েরও একটি অংশজুড়ে রয়েছে থ্যাকারের সিলেট জীবনের বর্ণনা। আর এই দুটো বইয়ে তাই উপনিবেশ আমলের সিলেট সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য রয়েছে । বই দুটো যাঁরা লিখেছেন তাঁরা দুজনেই ইংরেজ এবং উপনিবেশ শাসনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। তাই এই দুটো বইয়ে উপনিবেশ আমলের সিলেটের যে চিত্র পাওয়া য়ায়, তা ঐতিহাসিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য।

জৈন্তার রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীত
জৈন্তার রাজবাড়ীর ধ্বংসাবশেষ। ছবি: সংগৃহীত

মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার
তৎকালীন সিলেটে মুদ্রা হিসেবে কড়ির (cowry) প্রচলন ছিল। লেনদেনের মাধ্যম ছিল কড়ি। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে কিন্তু এর প্রচলন ছিল না। এই কড়ি মূলত সামুদ্রিক শামুকের খোলস। সমুদ্র থেকে শত শত মাইল দূরে অবস্থিত এই সিলেটে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার খুবই আশ্চর্য লেগেছিল লিন্ডসের কাছে। রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমও ছিল এই কড়ি। তখনকার সময়ে ৫ হাজার ১২০ কড়িতে হতো ১ টাকা। আবার পাউন্ডের হিসাবে ৪০ হাজার ৯৬০ কড়িতে হতো ১ পাউন্ড।


থ্যাকারের সময়ে সিলেটের রাজস্ব ছিল ১৭ হাজার পাউন্ড বলে উল্লেখ করেছেন ব্রাডলি বার্ট। মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহারের কারণে রাজস্ব আদায় করে কলকাতায় পাঠাতে বেশ সমস্যায় পড়েছিলেন থ্যাকারে। কারণ কড়িকে তখন রুপিতে রূপান্তর করতে হতো। তাই তিনি কোম্পানিকে পরামর্শ দেন কড়িগুলোকে প্রথমে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। এরপর সেগুলোকে সেখানে বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ বিল অব এক্সচেঞ্জের মাধ্যম কলকাতায় পাঠিয়ে দিতে। শেষ পর্যন্ত কোম্পানি থ্যাকারের পরামর্শ গ্রহণ করে।


লিন্ডসে লিখেছেন, তাঁর সময় সিলেটের রাজস্ব ছিল ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। লিন্ডসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী হিসাব করলে দেখা যায়, তাঁর সময় এটি ছিল ৩১ হাজার ২৫০ পাউন্ড। অর্থাৎ তা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছিল। লিন্ডসের সময় ও থ্যাকারের আমলের চালু করা নিয়ম অনুযায়ী কড়িগুলোকে ঢাকায় পাঠানো হতো। কড়িগুলো ঢাকাতে পাঠানোর আগে গুদামে রাখা হতো। বছর শেষে এসব কড়ি ঢাকায় পাঠানো ছিল বেশ ঝামেলার কাজ। সংগ্রহ করে গুদামজাত রেখে পরে ঢাকায় পাঠানো—এই প্রক্রিয়ায় ১০ শতাংশ কড়ি নষ্ট হয়ে যেত বলে উল্লেখ করেছেন লিন্ডসে। পরবর্তীকালে, সিলেটে মুদ্রা হিসেবে কড়ির ব্যবহার বিলুপ্ত হয় জন উইলিস সিলেটে কালেক্টর হয়ে আসার পর। তিনি কড়ির পরিবর্তে রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন করেন।

সিলেট বিদ্রোহের স্থান। ছবি: সংগৃহীত
সিলেট বিদ্রোহের স্থান। ছবি: সংগৃহীত

হাতির কারবার
থ্যাকারে ও লিন্ডসে সিলেটে এসে হাতির কারবার করেছেন দেদার। প্রাচীনকাল থেকেই এই উপমহাদেশে যুদ্ধে হাতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর এসব হাতি সরবরাহের একটা বিরাট অঞ্চল ছিল পূর্ব বাংলা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই উপমহাদেশে আসার পর ধীরে ধীরে হাতির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল। আর তাই তারা হাতি সংগ্রহের জন্য সিলেটকেও বেছে নিয়েছিল। কারণ, তখন সিলেট প্রচুর হাতি পাওয়া যেত তখন। প্রথমে কোম্পানি নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় হাতি সংগ্রহ করত। কিন্তু একসময় কোম্পানি বুঝতে পারল নিজে সংগ্রহ না করে বাজার থেকে এটি সংগ্রহ করা অনেকটা সাশ্রয়ী। তাই তারা স্থানীয় কালেক্টরদের হাতে বিষয়টি ছেড়ে দেয়। আর সেটারই সুযোগ কাজে লাগান থ্যাকারে ও লিন্ডসে দুজনেই।

আর এই হাতির ব্যবসার দেনা-পাওনা নিয়েই থ্যাকারে আর কোম্পানির মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয় বলে উল্লেখ করেছেন ব্রাডলি বার্ট। একবার থ্যাকারে কোম্পানির কাছে ৬৬টি হাতি বিক্রি করেন। কিন্তু দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে পাটনাতে পৌঁছানোর আগেই কয়েকটি হাতি মারা যায়। ফলে কোম্পানি হাতিগুলোর মূল্য পরিশোধ নিয়ে টালবাহানা করছিল। আর এতেই কোম্পানির সঙ্গে থ্যাকারের দ্বন্দ্বের শুরু।
লিন্ডসে লিখেছেন, তাঁর সময়কালে সিলেটে বছরে কমপক্ষে ৫০০ হাতি ধরা হতো। তিনি নিজেই ১৫০ থেকে ২০০ হাতি ধরতেন বছরে। তিনি লিখেছেন, ‘...হাতি ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বিক্রির ব্যবস্থা করতাম। এক শ থেকে দেড়-দুই শ হাতিকে চার ভাগে ভাগ করে সাধারণ একেকজন পিয়নের দায়িত্বে ছেড়ে দিতাম। তারা হাতির পাল নিয়ে দিল্লি, শ্রীরঙ্গপত্তম, হায়দারাবাদ, পোনা প্রভৃতি দূর অঞ্চলে গিয়ে বিক্রি করত।...’

প্রিন্স অব ওয়েলস পরে এডওয়ার্ড সপ্তমকে দেখা যাচ্ছে ভারত ভ্রমণের সময় হাতি নিয়ে শিকারে বের হয়েছেন। ছবিটি ১৮৭৫ সালের।
প্রিন্স অব ওয়েলস পরে এডওয়ার্ড সপ্তমকে দেখা যাচ্ছে ভারত ভ্রমণের সময় হাতি নিয়ে শিকারে বের হয়েছেন। ছবিটি ১৮৭৫ সালের।

জাহাজের ব্যবসা
অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে লিন্ডসে ওই সময় সিলেটে জাহাজ নির্মাণ করেছেন এবং বিক্রিও করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘...সিলেটে প্রচুর কাঠ ও লোহা পাওয়া যায়। আমাদের নৌকার মিস্ত্রিও আছে। পাল তৈরির জন্য তাঁতিও সুলভ। কিন্তু কাজটি খুব দুরূহ। সমুদ্র থেকে অনেক দূরে কুড়িটি জাহাজ নির্মাণ চাট্টিখানি কথা নয়। বড় বাধা ছিল আবহাওয়া। ...কঠিন এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ভাগ্যক্রমে আমার শরীর ও স্বাস্থ্য ছিল অনুকূল। ফলে আশাতীত সাফল্য লাভ করি।...’ লিন্ডসে সিলেটে মোট কুড়িখানা জাহাজ নির্মাণ করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে জাহাজ তিনি নির্মাণ করেছিলেন তার নাম দিয়েছিলেন ‘দ্য অগাস্টা’ (৪০০ টন)। সিলেট থেকে কীভাবে এটি সমুদ্রে নিয়েছিলেন তিনি তা পড়লে এখন অবিশ্বাস্য মনে হয়। জাহাজখানা আফিম নিয়ে মালাক্কার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল। পথে এটি চীনের ম্যাকাওতে থেমেছিল। গন্তব্যস্থানে পৌঁছে জাহাজটি একজন পর্তুগিজ ব্যবসায়ীর কাছে ভালো দামে বিক্রি করা হয় বলে উল্লেখ করেছেন লিন্ডসে।


চুনাপাথর
উপনিবেশ আমলে সিলেট ছিল চুনাপাথর সরবরাহের একটি বিরাট কেন্দ্র। আসলে চুনাপাথর সিলেটে পাওয়া যেত না। এগুলো আসত আসাম, কাছাড় খাসিয়া ও জৈন্তা অঞ্চল থেকে। সে সময় ওই সব অঞ্চল সিলেটের নামে পরিচিত হওয়ার কারণে সিলেট হয়ে পড়ে চুনাপাথর সরবরাহ আর ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু।
ব্রাডলি বার্ট লিখেছেন, চুনাপাথর ছিল সিলেটের প্রধান অর্থকরী পণ্য। সে সময় সিলেট থেকে প্রতিবছর ১ লাখ ২০ হাজার মণ চুনাপাথর সরবরাহ করা হতো। আর এই চুনাপাথর সরবরাহের ব্যবসা খুবই লাভজনক হওয়ায় কোম্পানি কালেক্টরের মাধ্যমে এই ব্যবসা নিজেদের কবজায় আনতে চেয়েছিল। আর এই জন্য তারা থ্যাকারে–কে দায়িত্ব দিয়েছিল এই সব দেখভাল করার। থ্যাকারেকে অবশ্য এই নিয়ে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।


অন্যদিকে লিন্ডসে সিলেটে এসে চুনাপাথরের ব্যবসা থেকে লাভ করেছেন প্রচুর। তিনি লিখেছেন, এই চুনাপাথরের ব্যবসা তাঁকে আশাতীত লাভ এনে দিয়েছিল। তাঁর মতে, সিলেট থেকে প্রাপ্ত চুনাপাথর ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের চুনাপাথরের চেয়ে উৎকৃষ্টতর ছিল। আর এই ব্যবসাতে অনেক আর্মেনিয়ান, গ্রিক ও ইউরোপিয়ান জড়িত ছিলেন। তিনি একসময় তাঁদের কৌশলে হটিয়ে চুনাপাথরের ব্যবসায় তাঁর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন বলেও তিনি লিখেছেন।


জৈন্তা বিজয়
ওই সময় বর্তমান জৈন্তাপুর অঞ্চল পৃথক রাজার অধীনে ছিল। রাজার নাম ছিল ছত্রসিংহ। তিনি ছিলেন খাসিয়া। সিলেটের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে চুনাপাথর নদীপথে সিলেটে নিয়ে আসার সময় জৈন্তা হয়েও আসতে হতো। ফলে কোম্পানির চুনাপাথরের বহরে রাজা প্রায়ই বাধার সৃষ্টি করতেন। ফলে থ্যাকারে তাঁর সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেন জৈন্তার রাজার বিরুদ্ধে অভিযানের। ১৭৭৪ সালের মার্চ মাসে এটি সংঘটিত হয় বলে ব্রাডলি বার্ট উল্লেখ করেছেন। ওই যুদ্ধে জৈন্তার রাজা পরাজিত হন এবং কোম্পানির কোনো কাজে বাধা দেবেন না বলে একটি চুক্তি করতে বাধ্য হন।


লিন্ডসে সিলেটে অবস্থানকালে একবার জৈন্তার রাজার আতিথেয়তা গ্রহণ করেছিলেন বলে বইয়ে উল্লেখ করেছেন। ইয়োটে করে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। তিনি শিকারও করেছেন। হাতি–মহিষের লড়াইও দেখেছেন। সর্বমোট তিন দিন রাজার অতিথি হয়ে ছিলেন তিনি।


প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে লিন্ডসে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ঢাকা থেকে তিনি যখন প্রথমবার সিলেটে আসেন তখন সিলেটের কাছাকাছি পৌঁছানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘...ঢাকা থেকে সাত দিন চলার পর সিলেটের পর্বতমালা দৃষ্টিগোচর হলো। পাহাড়গুলো দূরে কালো মেঘের মতো মনে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে খাড়া পাহাড়ের গায়ে শুভ্র, অপরূপ দৃশ্য।’...


সিলেট শহর অবশ্য ততটা বিস্তৃত হয়নি তখন। তাঁর কাছে শহরকে মনে হয়েছিল কয়েকটি বাজারের সমষ্টি। আর উঁচু–নিচু টিলার ওপর বিক্ষিপ্ত বাড়িগুলোকে তাঁর মনে হয়েছিল ঘন গাছপালায় ঘেরা। একবার পান্ডুয়া (pandua) নামক স্থানে গিয়েছিলেন চুনাপাথরের বিষয়ে আলাপ করতে। ওই সময়ের পান্ডুয়ার সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। বিস্মিত হয়ে তিনি তাঁর এক কাব্যিক বিবরণ দিয়েছেন,
‘...পাহাড়ের নিচে পান্ডুয়া পৃথিবীর বৃহত্তম এক উন্মুক্ত রঙ্গমঞ্চ। পাহাড়টি মনে হয় যেন হঠাৎ করে সমতল জলাভূমি থেকে ওপরে উঠে গেছে। পর্বতমালা বন–বনানী মনোহর পত্রপল্লবে শোভিত। চারদিকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের নানা প্রজাতির ফলদ বৃক্ষের সারি। ...নিসর্গের এত মনোরম রূপ আমি কোথাও দেখিনি।’

উপনিবেশ আমলে হাতি ব্যবহার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত
উপনিবেশ আমলে হাতি ব্যবহার ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ছবি: সংগৃহীত

মহররম বিদ্রোহ
লিন্ডসে সিলেটে থাকাকালে কোম্পানির বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ মোকাবিলা করেছিলেন ১৭৮২ সালে। ইতিহাসে এটি ‘মহররম বিদ্রোহ’ বা ‘সিলেট বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। এটিকে উপমহাদেশের প্রথম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটি ধরা হয়। এটি সংঘটিত হয়েছিল সিলেটের শাহি ঈদগাহ এলাকাসংলগ্ন টিলাতে। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন শহরের কুমারপাড়া–সংলগ্ন ঝরনারপারের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ পরিবারের সৈয়দ হাদী এবং সৈয়দ মাহদী ভ্রাতৃদ্বয়। ইতিহাসে তাঁরা হাদা মিয়া-মাদা মিয়া নামে খ্যাত।


রবার্ট লিন্ডসে লিখেছেন, তিনি আগে থেকেই পীরজাদা ভ্রাতৃদ্বয়ের ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। তিনি বিদ্রোহের তথ্য গুপ্তচরের মাধ্যমে জেনে যান এবং ১০ মহররম বিকেলে ঘোড়ায় চড়ে সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে শাহি ঈদগাহ ময়দানে হাজির হন। তিনি তাঁদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু সৈয়দ ভ্রাতৃদ্বয় ঘৃণাভরে ইংরেজ রেসিডেন্টের নির্দেশ অমান্য করলেন। এরপর শুরু হয় এক অসমযুদ্ধ। সৈয়দ হাদীর আঘাতের পর আঘাতে রবার্ট লিন্ডসের তরবারি খণ্ডিত হয়ে যায় এবং তিনি ধরাশায়ী হন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে পেছন থেকে একজন ইংরেজ জমাদার লিন্ডসের হাতে একটি পিস্তল এগিয়ে দিলে লিন্ডসে সঙ্গে সঙ্গে সৈয়দ হাদীকে গুলি করে হত্যা করেন। একইভাবে প্রতিরোধে এগিয়ে আসা অপর বীর সৈয়দ মাহদীও পিস্তলের গুলিতে শহীদ হন। তাঁদের অনুসারীরা পার্শ্ববর্তী পাহাড়-টিলায় অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধ চালিয়ে গেলেও বিদ্রোহের দুই নেতা শহীদ হওয়ায় তাঁরা মনোবল হারিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। আর লিন্ডসে বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হন।

ডেপুটি কালেক্টররা তখন একাধারে ছিলেন কোম্পানির প্রতিনিধি, রাজস্ব আদায়কারী, শাসক, বিচারক এবং সেনাপ্রধান। তাঁদের ক্ষমতা আর স্বাধীনতা ছিল অনেক। সেই সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত ব্যবসা, আয়–উপার্জন ইত্যাদি করার অনুমতি ছিল তখন। এঁদের অনেকেই ছিলেন তৎকালীন ব্রিটেনের মধ্যবিত্ত আর নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কিন্তু তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল অনেক। নিজের ভাগ্য গড়ার এক মোক্ষম সুযোগ মনে করতেন তাঁরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই চাকরিকে। সে জন্য কোম্পানির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই চাকরির পাশাপাশি এখানে ব্যবসা–বাণিজ্য করে নিজেদের ভাগ্য গড়ে নিয়েছেন। ফিরে গেছেন বিত্তশালী হয়ে। আর এই জন্য তাঁরা যখন যা যা করার দরকার তা করেছেন।


লিন্ডসের কথাই ধরি। তাঁর আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন স্পেনের ষাঁড়ের লড়াই তাঁর কাছে নিষ্ঠুর মনে হয়েছিল। অথচ এই তিনিই এই সিলেটে আসার পরে শত শত হাতি ধরেছেন, বাঘ ধরেছেন, গন্ডার মেরেছেন, হরিণ ও পাখি শিকার করেছেন। আবার ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দমনের সময় মানুষও হত্যা করেছেন অবলীলায়।


কোম্পানির রেসিডেন্ট হিসেবে সিলেটের পদটি বেশ লোভনীয় ছিল। সেটা লিন্ডসে স্বীকার করেছেনই এবং সেই সঙ্গে তিনিও নিজে কীভাবে সিলেটের এই পদটির জন্য অনেকটা তদবির করে এবং কিছুটা চালাকি করে বাগিয়ে নিয়েছিলেন সেটাও বলেছেন অবলীলায়। আর তাঁর এই সিলেটে আসার আগ্রহের পেছনে ছিল এখানকার সম্পদের প্রতি লোভ, সেটাও তিনি বলেছেন। থ্যাকারে ও লিন্ডসে কোম্পানির কাজ তো যা করার করেছেনই, সেই সঙ্গে চুনের ব্যবসা, হাতি ধরার ব্যবসা, ধানের ব্যবসা, পানের ব্যবসা, জাহাজের ব্যবসাসহ আরও নানা কিছু করছেন। এ দেশ থেকে তাঁরা কামিয়েছিলেনও প্রচুর। আর পরে নিজ দেশে গিয়ে এই সব টাকাপয়সায় প্রচুর সম্পদের মালিক হয়েছিলেন দুজনেই।


*রবার্ট লিন্ডসের আত্মজীবনী বাংলাতে অনুবাদ করছেন আব্দুল হামিদ মানিক। অনুবাদগ্রন্থের নাম দিয়েছেন ‘সিলেটে আমার বারো বছর’ (২০০৩)। রবার্ট লিন্ডসের বই থেকে সরাসরি কোনো অংশ উল্লেখের ক্ষেত্রে তার অনুবাদগ্রন্থটির সাহায্য নেওয়া হয়েছে।

*লেখক, বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। [email protected]