করোনা-পরবর্তী বিশ্ব চলবে নতুন মোড়কে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নতুনত্ব যেমন সমাজে পরিবর্তন আনে, তেমনি করোনা–পরবর্তী বিশ্বে বিরাট পরিবর্তনের আশা করা যায়। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব বর্তমান বিশ্বকে যেমন ভাবাচ্ছে, ভবিষ্যতে এর ভাবনা আরও বিস্তৃতি লাভ করতে পারে। এই ভাবনাগুলো সমগ্র বিশ্বকে যেমন নতুন কিছুর শিক্ষা দেবে, তেমনি সমাজের অনেক পরিবর্তনও বয়ে নিয়ে আসবে।

চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস সেখানে উহানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল কি না, আমার জানা নেই। তবে তারা তাদের আরোপিত লকডাউন প্রাথমিকভাবে তুলে নিতে সক্ষম হয়েছিল ৮ এপ্রিল। ভাইরাসটি নিয়ে আমার সন্দেহের সবচেয়ে বড় পয়েন্ট হলো সমগ্র চীনকে আক্রান্ত না করলেও পুরো বিশ্বকে কাবু করে ফেলেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের আক্রান্তের সংখ্যাও চীনের চেয়ে বেশি। আর সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের নাজেহাল অবস্থার কথা না–ইবা বললাম। এসবের ফলে সমগ্র বিশ্ব অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে শুরু করেছে।

প্রথম শনাক্ত ও মৃত্যুর পরও স্বাভাবিক গতিতে চলছে চীনের অর্থনীতি। অনেকের মতো আমারও মনে হয় অস্বাভাবিক নয় এটি ল্যাবরেটরিতে পালিত একটি ভাইরাস। পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় করে শাসন চালানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পৃথিবীতে নিয়ে ঠান্ডা মাথায় যে খেলা যায় তারই নিদর্শন হয়তো স্থাপন করল চীন।

বিশ্বের পরাশক্তিগুলো জানে শুধু কীভাবে মিসাইল ব্যবহার করে মানুষ মারতে হয়। অস্ত্রের ঝনঝনানিতে কীভাবে অসহায় মানুষের ওপর লাগামহীন নির্যাতন চালাতে হয়। বিশ্বক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে এসব বর্বরোচিত হামলা করতেই কেবল জানে তারা। অথচ বিশ্বের অনেক মানুষ অনাহারে দিন কাটায়। তাদের এসব অস্ত্রশস্ত্র তাদের অনেকটা বর্বর বানিয়ে দিয়েছে। যদিও তারা নিজেদের সভ্যতার মানদণ্ড হিসেবে দাবি করে আসছে! মারণাস্ত্রের জন্য তারা রাজস্ব আয়ের মোট বাজেটের প্রায় অর্ধাংশের বেশি খরচ করে সামরিক খাতে, যা কয়েকটি দেশের মোট বাজেটের সমপরিমাণও বটে। অথচ স্বাস্থ্য খাতের দিকে কিংবা ভাইরাস ঠেকাতে তাদের কোনো নজরই ছিল না।


কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিদেল কাস্ত্রোর সমাজতান্ত্রিক দেশ কিউবা শেখাচ্ছে মুনাফাবিহীন মাধ্যমে কীভাবে বিশ্বায়ন ঘটানো সম্ভব। তারা পুরো বিশ্বকে শিক্ষা দিচ্ছে মানুষের তরে মানুষ। জীবন বাঁচানোর মতো মহৎ কাজ। কোনো অস্ত্রের ঝনঝনানি নয়।


এটি বলার কারণ, করোনা–পরবর্তী বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেবে যেমন স্পষ্ট, তেমনি কর্মহীন হয়ে পড়বে লাখ লাখ মানুষ, যা এখন থেকেই দৃশ্যমান। কৃষক অর্থের অভাবে জমিতে ফসল উৎপাদন করতে পারবে না, দেখা দিতে পারে দুর্ভিক্ষ। এরই মধ্যে আশঙ্কা রয়েছে পঙ্গপালের আক্রমণের আশঙ্কা।

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

লেনদেনের হিসেবে এই গ্রহে অন্য সব পেশাজীবীর চেয়ে একজন খেলোয়াড়ের দাম সবচেয়ে বেশি। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে জীবন যেখানে অনিশ্চিত, খেলাধুলা সেখানে আমড়া কাঠের ঢেঁকি। ইতিমধ্যে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানান দিচ্ছে কয়েকটি ক্লাব বর্তমান পরিস্থিতির কারণে দেউলিয়া হতে পারে। তা ছাড়া সমগ্র বিশ্বে সব ধরনের খেলাধুলা বন্ধ করে দিয়েছে। পাশাপাশি বহাল রেখেছে লকডাউন। যদিও ইতিমধ্যে কয়েকটি লিগভিত্তিক খেলা শুরু হয়েছে দর্শকবিহীনভাবে। আর এই লকডাউনের মধ্য দিয়েও থেমে নেই ভাইরাসের বিস্তার। ঘরের ভেতর থেকে শুরু করে ছড়িয়ে পড়েছে মহাদেশগুলোতে। সেবার জন্য দরকার চিকিৎসক ও নার্স । কিন্তু তার যথেষ্ট সংকট। তাই পরিস্থিতি জানান দিচ্ছে এই জগতে চিকিৎসক–নার্সের চেয়ে দামি কোনো পেশাজীবী নেই। জীবন বাঁচাতে যাঁরা সহযোগিতা করেন তাঁদের চেয়ে মহান আর কেউ নেই।

পূর্বকথা অনুযায়ী যদি চীন একান্তই বিশ্বকে স্থবির করে দেওয়ার জন্য এই উপায়টি গ্রহণ করে থাকে তবে আগামীর বিশ্বনেতৃত্ব তাদের। আর বিশ্বনেতৃত্ব না পেলেও বলা যাবে যুক্তরাষ্ট্র অল্প করে হলেও তার শ্রেষ্ঠত্ব কিছুটা হারিয়েছে। সেই হিসেবে পশ্চিমারা আসলে ততটুকু মেধাবী নয়, যতটা আমরা মনে করে থাকি।

বিশ্ববাজারে তেলের খুব চাহিদা। পুরো বিশ্ব লকডাউনের ফলে যানবাহন বন্ধ। ব্যবহার একেবারেই হচ্ছে না তেলের। ফলে উল্লেখযোগ্য হারে কমছে তেলের চাহিদা। অথচ এই তেলের জন্য আমেরিকা আফগানে ঘাঁটি স্থাপন করল। ইরাকে হামলা করে তাদের অর্থনৈতিকভাবে শত বছর পিছিয়ে দেওয়া হলো। অথচ আজ পৃথিবী যেমন নীরব, তেলের ব্যবহারও কম। ফলে কমছে পরিবেশদূষণও।
প্রকৃতি আবারও নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে আপন রূপে। পাখি ডাকছে ঘরের ব্যালকনিতে। এখন আর সারা দিন গাড়ির হর্ন বাজে না। আসে পাখির কলরব। আর অর্থ-সম্পদ কোনো কাজেরই না। যদি–না প্রকৃতি আমাদের দয়া না করে। যেকোনো দুর্ভিক্ষ বলে দিতে পারে আমি–আপনিসহ পুরো পৃথিবী কত অসহায়। যেখানে খাদ্য নেই, সেখানে অর্থ–সম্পদও কাজে আসে না। যেমন আমরা ভাইরাসের ক্ষেত্রে দেখেছি যে ভ্যাকসিন কিংবা কার্যকরী ওষুধ ব্যতীত চিকিৎসাসেবাও অসহায় জীবন বাঁচাতে। অতএব অর্থসম্পদ কোনো কাজেরই না যদি প্রকৃতি আশীর্বাদ না করে।

রয়টার্স প্রতীকী ছবি
রয়টার্স প্রতীকী ছবি

মাঝেমধ্যে মনে হয় পরবর্তী বিশ্ব পুরোটা কৃষিনির্ভর হয়ে উঠবে। অর্থনীতির মোড় ঘোরাবে কৃষি! যা বর্তমানে অনেক গ্র্যাজুয়েটের দিকে কৃষিকেন্দ্রিক সফলতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায়। আবার বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষ ভাবছে এই অবস্থায় কীভাবে খেয়ে বাঁচা যায়। করোনার সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রযুক্তিনির্ভর যেসব দেশ কৃষির ওপর নির্ভরশীল নয়, তারা প্রতিনিয়ত খাদ্য আমদানি করছে। এই পরিস্থিতিতে যেকোনো কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র অন্য একটি প্রযুক্তিনির্ভর রাষ্ট্রকে খাদ্যসংকটে ফেলে অধিক মুনাফা গ্রহণ করতে পারে, যা উন্নত বিশ্বের যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য হুমকিস্বরূপ।
আদিম যুগ থেকে মানুষ পশুপাখি গৃহপালনের জন্য কিছু প্রাণীকে বসে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তাদের কাছে গৃহের বন্দিজীবনে বেশ স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। কিন্তু তারপরও মুক্তমনা কিছু প্রাণী বনবাসকেই আপন করে নিয়েছে। কিন্তু এই মুক্তমনা বন্য প্রাণীদের দ্বারা মানুষকে বিনোদনের জন্য চিড়িয়াখানা স্থাপন করা হয়েছে। ফলে তাদের মুক্ত জীবনে আসে বিচারবিহীনভাবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। পাষণ্ড এক মানবতাহীন সমাজ গড়ে তুলে কবি বলেন, ‘বন্যেরা বনে, সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।’ আজ এই অসহায় পরিস্থিতিতে চিড়িয়াখানার পশুপাখিদের মতো বন্দিজীবন পার করছে পুরো বিশ্ববাসী। হৃদয়ে এবার যদি বিঁধে পশুপাখির বন্দিজীবনের কথা। কেমন করে তারা পার করে জীবন, সেই অনুভূতিতে যদি মুক্ত পায় হাজারো পশুপাখি। জানি, বিশ্ব এ থেকেও শিক্ষা নেবে না। আবার পশুপাখি নিরাপত্তাবিষয়ক অনেক সেমিনার, কনফারেন্স, বন বিভাগ, পশু বিভাগ নামক শাখা খুলবে কিংবা খোলা থাকবে। তবু পশুপাখির নিরাপত্তা আসবে না। কিন্তু বিশ্বমানবতাকে ঠিকই ভাবাতে পারে।

বিশ্বকে আরও ভাবাতে পারে যে বিশ্বায়নের যুগে মহামারি এক স্থানে সৃষ্টি হলেও পরে পুরো বিশ্বকে এই মহামারিতে আক্রান্ত করার সহজ পথ এই গ্লোবালাইজেশনই। যা আমরা উহানের সঙ্গে বিশ্ব যোগাযোগের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই বুঝতে পারি। আবার যারা ফাস্ট ফুডপ্রিয়, তারাও শিখে গেছে সাধারণ খাদ্য খেয়েও জীবন পার করা যায়। ফলে ফাস্ট ফুডের দিকে বিশ্ববাসীর ঝুঁকি কমে যেতে পারে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যসচেতন হয়ে বাঁচা যে কোনো কঠিন কাজ নয় তারও শিক্ষা পাচ্ছে বিশ্ববাসী। এখন ব্যক্তির কাছে নিজের পরিবারই সবচেয়ে বড়। পৃথিবী ঘিরে শুধু ব্যক্তির পরিবারকেন্দ্রিক ধারণা বিস্তৃত পাচ্ছে।

*শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়