বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসরুম সবার, অনলাইন ক্লাসরুম কি সবার

করোনাভাইরাস নামক বৈশ্বিক মহামারির থাবায় সমগ্র বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে আছে ১৭ মার্চ থেকে। স্কুল, কলেজের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও একই সময় থেকে বন্ধ থাকায় শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ সেশনজটের। এ অবস্থায়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক ‘জরুরি’ ভিডিও কনফারেন্সে ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মিলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনলাইন ক্লাসের কার্যক্রম শুরু করতে রাজি হয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোয়। পুরোনো বেঞ্চ আর জীর্ণশীর্ণ ‘এনালগ’ ক্লাসরুম থেকে স্মার্টফোনের ‘ডিজিটাল’ ক্লাসরুমে উন্নিত হওয়ার এ সংবাদে আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয় লক্ষ করা যাচ্ছে শিক্ষার্থীদের বিপরীতধর্মী প্রতিক্রিয়াও।

পরীক্ষামূলক অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম
করোনা মহামারির এই দীর্ঘ বন্ধে সৃষ্ট সম্ভাব্য সেশনজট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা হিসেবে কিছুদিন আগে থেকেই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাশাপাশি পরীক্ষামূলক ‘অনলাইন ক্লাস’ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল বেশ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েও। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ–সংক্রান্ত কোনো কার্যক্রমই লক্ষ করা যায়নি। মূলত, অনলাইন ক্লাস করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অপ্রতুল সুযোগ–সুবিধা এবং শিক্ষকদের ক্লাস নিতে অনীহাই ছিল প্রধান কারণ বলে জানিয়েছিল সংবাদমাধ্যমগুলো। গত ৮ মে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ঢাবি কর্তৃপক্ষ তাড়াহুড়ো করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে জানিয়েছিলেন অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান।

পরীক্ষামূলক অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদেরও এ বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। তাঁদের মতে, অনলাইন ক্লাসরুম নতুন কিছু শেখার ক্ষেত্রে তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। উপরন্তু লাইভ ক্লাসে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর উভয়েরই অনভিজ্ঞতা কমিয়ে দিচ্ছে ক্লাসের কার্যকারিতা।

প্রতিবন্ধকতা
সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে দেশের বিভিন্ন প্রত্যঞ্চ অঞ্চল থেকে ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে শুধু মেধার যোগ্যতাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা। এসব শিক্ষার্থীর অনেকে যেমন বিত্তশালী পরিবার থেকে উঠে আসা, অনেকের আবার উঠে আসা হতদরিদ্র পরিবার থেকে। রাজধানীর বিলাসবহুল বাড়িতে বসবাস করা শিক্ষার্থীর পাশাপাশি রয়েছেন প্রত্যঞ্চ গ্রামাঞ্চলের কুঁড়েঘরে বসবাস করা শিক্ষার্থীও। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম’ সবার জন্য সমান সুযোগ–সুবিধা সৃষ্টি করলেও ‘অনলাইন ক্লাসরুম’–এ সুযোগ সৃষ্টি করবে কি না, প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মনে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত প্রায় সোয়া আট লাখ শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই গ্রামাঞ্চলে বসবাস করায় উচ্চগতির ইন্টারনেট–সুবিধার বাইরেই রয়েছেন তাঁরা। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের রয়েছে ডিভাইসের স্বল্পতা। উপরন্তু ডেটা প্যাক কিনে লাইভ ক্লাস করার সক্ষমতা কতজনের রয়েছে, এ নিয়ে প্রকৃত কোনো গবেষণা ছাড়াই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটুকু যৌক্তিক, বিষয়টা ভাবনার উদ্রেক করে।

কিছুদিনে অনলাইন ক্লাসের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বিভিন্ন সংস্থার জরিপেও শিক্ষার্থীদের এসব সমস্যার কথা উঠে এসেছিল। ইউজিসির চেয়ারম্যান কাজী শহীদুল্লাহ গত ১৩ মে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাস্তবতা হলো, বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে পড়াশোনার মতো সুযোগ-সুবিধা নেই। সেশনজট কীভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা আছে। সেই অভিজ্ঞতায় অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে হয়তো একটি সেমিস্টারের (ছয় মাস) সেশনজট মোকাবিলা করতে পারবে।’ পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের এসব ঘাটতি মোকাবিলায় সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ তো গ্রহণ করা হয়ইনি শিক্ষা, বরং জাতীয় বাজেটে বাড়ানো হয়েছে মোবাইল ডেটা কেনার ওপর সম্পূরক শুল্ক। অথচ এর ঠিক এক মাস পরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব অবকাঠামোগত এবং দেশের ইন্টারনেট সক্ষমতার কোনো পরিবর্তন না আসলেও অনলাইন ক্লাসের সিদ্ধান্ত নিল ইউজিসি।

বিকল্প কী
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু তথা অনলাইন ক্লাসের বিকল্প আপাতত নেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে করোনা মহামারির এ সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিত অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রয়েছে। যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিও আগামী বছরের মাঝামাঝি অবধি সম্পূর্ণরূপে অনলাইন ক্লাস চালু রাখার ঘোষণা দিয়েছে। তবে, এসব উন্নত দেশের মতো একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরাও যে সফল হতে পারব, সে সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অনলাইন ক্লাসের কার্যক্রমে সফলতা আনতে হলে নিজেদের মতো করে কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

১.
Zoom, Google Meet–এর মতো লাইভ কনফারেন্স অ্যাপসে সবাইকে একসঙ্গে এনে ক্লাস করানোর পরিবর্তে ফেসবুক লাইভ অথবা ইউটিউবে ভিডিও কন্টেন্ট আপলোড করে রাখা শিক্ষার্থীদের জন্য সুবিধাজনক হবে। এতে সুবিধাজনক সময়ে শিক্ষার্থীরা সেটি দেখতে পারবে। আমাদের দেশের নিম্নগতির ইন্টারনেট ব্যবস্থায় ‘লাইভ ক্লাস’ ধারণাটি বাফারিংয়ের কবলে পড়ে ব্যর্থ হতে পারে।

২.
সহজ শর্তে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ডিভাইস কেনার জন্য ঋণ প্রদান করতে হবে। সরকার, ইউজিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল ছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে পারে।

৩.
গ্রামপর্যায়ে মোবাইল ইন্টারনেটের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ডেটা প্যাকের দাম শিক্ষার্থীবান্ধব রাখতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ডেটা প্যাক কেনার জন্য সহযোগিতা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে ডেটা প্যাকের দাম কমানো হলেও ইন্টারনেটের সক্ষমতা বৃদ্ধি না পেলে সেটি কোনো কাজেই আসবে না।

৪.
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে কার্যকর শিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

সর্বোপরি, শতভাগ শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় না এনে মুষ্টিমেয়কে নিয়ে এ ধরনের কার্যক্রম চালু সমাজে বৈষম্যের উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে। দুর্বল নেটওয়ার্ক কিংবা ডিভাইসের স্বল্পতায় ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে না পারা কোনো বন্ধুকে পেছনে ফেলে একা এগিয়ে যাওয়া একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর জন্যও সুখকর কোনো অভিজ্ঞতা নয়। তাই এ মুহূর্তে তাড়াহুড়ার মাধ্যমে কোনো সিদ্ধান্তে আসার পরিবর্তে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার আলোকে শতভাগ শিক্ষার্থীকে অনলাইন ক্লাসের আওতায় এনে কার্যক্রম শুরু করা সবার জন্যই মঙ্গলজনক। যেটি সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে মুখ্য ভূমিকা রাখবে।

*শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়