নেক্সাস পরিবারের টাঙ্গুয়ার হাওরে জ্যোৎস্নাবিলাস

শ্রাবণের বাদলা দিনে নেক্সাস রয়েল ক্লাবের ৪০ জন হাওরে। ছবি : সংগৃহীত
শ্রাবণের বাদলা দিনে নেক্সাস রয়েল ক্লাবের ৪০ জন হাওরে। ছবি : সংগৃহীত

সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝটিকা সফর হয়েছে বেশ কবার। যে কবার গিয়েছি ওখানে থিতু হতে না পেরে বুক ভার করা অতৃপ্তি নিয়েই বাড়ি ফিরেছি।

অতৃপ্তি হবেই–বা না কেন!

সর্বশেষ গেল বছরের শ্রাবণের বাদলা দিনে নেক্সাস রয়েল ক্লাবের ৪০ জনের একটা টিম নিয়ে ট্রলারে যাত্রা শুরু করলাম। যখনই আমাদের নৌকাটি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করতে করতে হাওরের সীমানায় গিয়ে পড়ল, অমনি মেঘালয় রাজ্যের মেঘমালা পুরো আকাশটাকে মেঘমুক্ত করে স্নিগ্ধ রোদের হাসিতে আমাদের স্বাগত জানাল।

চোখে পড়ল চারপাশ পাথরে বাঁধানো বাড়িঘর। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি ডিঙি নৌকা করে মানুষজনের আনাগোনা। হাওরের ঢেউগুলো গিয়ে লাগছে বাঁধাই করা পাথরের ওপর। কখনো একটি বাড়ি নিয়েই একটি গ্রাম। দূরের জনপদগুলোকে দেখতে অনেকটাই দ্বীপের মতো লাগছে।

হরহামেশাই হিজল, করচ আর সামান্য কিছু বরুণগাছের দেখা মিলল। উজানের পানি বানের জলের মতো ধেয়ে যাচ্ছে মেঘালয় রাজ্যের দিকে তবু গাছগুলো পানির বুক চিরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। অপরূপ রূপবৈচিত্র্য দেখে সবার মন তখন আনন্দে দোল খাচ্ছে।

আমাদের ঘড়ির কাঁটায় যখন ঠিক ২টা ১৫ মিনিট তখন নৌকাটি ভিড়ল টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ারটির পাদদেশে। সবাই দৌড়ে উঠল ওয়াচ টাওয়ারের সর্বোচ্চ সিঁড়ি পর্যন্ত। দু-একজন ফটোশুটের জন্য ক্যামেরা তাক করল। কেউ ব্যাগ থেকে দুরবিন বের করে যত দূর লেন্সের আওতায় আসে একপলকে দেখে নিল। আবার দুর্দান্ত সাহসী কজন ওয়াচ টাওয়ার থেকে লাইফ জ্যাকেট পরে লাফিয়ে পড়ল হাওরের স্বচ্ছ নীল পানিতে। বাকিরা যে যার মতো কিছুক্ষণ পানিতে সাঁতরে নিল।

খেয়ে নিলাম দুপুরের খাবার। শুরু হলো নানান প্রতিযোগিতা। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রতিভার ঝলক দেখাতে। আবৃত্তি, কৌতুক আর কেউ কেউ আবার সেলিব্রিটিদের নকল করেও দেখাল। সর্বশেষে একজন আবৃত্তি করলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘কেউ কথা রাখেনি’ কবিতাটি। সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। চমৎকার আবৃত্তি শুনে মনে হয়েছিল ওনার বোধ হয় জন্মই হয়েছে কবিতা আবৃত্তির জন্য!

ততক্ষণে চারদিকেই ছড়িয়ে পড়েছে গোধূলির আলো।

নীল আকাশ আর নীল স্বচ্ছ পানিতে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান বারবার। ছবি: লেখক
নীল আকাশ আর নীল স্বচ্ছ পানিতে ভ্রমণপিপাসুরা ছুটে যান বারবার। ছবি: লেখক

প্রতিটা জিনিসেরই একটা প্রতিবিম্ব থাকে। আকাশের স্বচ্ছ প্রতিবিম্ব আমি প্রথম দেখলাম টাঙ্গুয়ার হাওরে। হাওরের জলে তাকালে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে শিমুল তুলার মতো ঘন ঘন মেঘ। যেন ওগুলো আকাশে উড়ছে না, হাওরের জলে ভাসছে। একটু পরপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে ওরা হাওরের জলে ডুবসাঁতার দিচ্ছে। আমি জলে তাকিয়েই আকাশ, পাখি, মেঘ সব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। শুনেছি শীতকালে নাকি ওখানে সাইবেরিয়া থেকে পালকে বরফ জড়িয়ে প্রচুর অতিথি পাখি আসে। বর্ষায় গিয়েছিলাম বলে ওদের আর দেখা মেলেনি।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, হাওরে যখন সন্ধ্যা নামল, সেটা পৃথিবীর বাকি সমস্ত সন্ধ্যা থেকে একেবারেই আলাদা ছিল। নৌকায় চড়ে হিজল বনের ভেতর দিয়ে আস্তে আস্তে আমরা ওই সন্ধ্যার ভেতর ঢুকে পড়লাম। হাওরের শেষ সীমায় দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু পাহাড়গুলো হঠাৎ কান্না শুরু করল, অন্যদিকে দূর থেকে এক সারি হিজলগাছ মৃদু বাতাসে হাত নেড়ে তাদের সান্ত্বনা দিতে লাগল। মাঝখানের অথই জলরাশি নিজের মতো খেলা করে যাচ্ছে অবিরাম।
তখন রাত।

আমরা নৌকার ভেতর সামান্য বিশ্রাম নিচ্ছি। মাথার ওপরে একফালি চাঁদ। চাঁদের রুপালি জ্যোৎস্না জানালা গলে নৌকার ভেতরে ঢুকে পড়ছে। জ্যোৎস্না দেখতে নৌকার বাইরে বেরিয়ে এলাম। টাঙ্গুয়ার হাওরের কোনো একটা জায়গায় আমাদের নৌকাটা ভাসছে। ছলাৎ ছলাৎ ঢেউয়ের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। ফকফকে জ্যোৎস্নায় হাওরের পানি যেন আমার ছোট বোনের রুপার পায়েলের মতো চিকচিক করছে। শাপলা আর পদ্মফুলের গা থেকে ফড়িং উড়ে যাওয়ার দৃশ্যটাও আমার চোখে সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান হচ্ছে।

নিরাপত্তার জন্য হাওরে লাইফ জ্যাকেট পরেই নামা উচিত। ছবি: লেখক
নিরাপত্তার জন্য হাওরে লাইফ জ্যাকেট পরেই নামা উচিত। ছবি: লেখক

এই অপরূপ দৃশ্যপট দেখে আমি রবীন্দ্রসংগীত ধরলাম...
‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়ে আলো...।’

গান শেষ করে পাটাতনে শুয়ে লক্ষ লক্ষ তারার দিকে তাকিয়ে আছি। দূরে কোনো এক মাঝি হয়তো আমার গলা শুনেই হাঁক ছেড়ে শাহ আবদুল করিমের গান ধরলেন,
‘কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি…।’

আজকাল মন খারাপের দিনে যখন নিজেকে ওই জায়গায় দাঁড় করাই তখন সমস্ত কষ্ট ভঙ্গুর হয়ে যায়।
কখনো সমুদ্রে যাইনি তবে শুনেছি সমুদ্র খুব অহংকারী। সমুদ্র তার বুকে আকাশকে জায়গা করে দেয় না। এ জন্য সমুদ্রে কোনো প্রতিবিম্ব তৈরি হয় না। সি-বিচের লোনা পানিতেও নাকি নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মধুচন্দ্রিমায় (হানিমুনে) সমুদ্রে না গিয়ে ফের হাওরের কাছেই যাব।

*শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, আনন্দ মোহন কলেজ, ময়মনসিংহ