খুঁজে ফিরি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই বিদ্যাপীঠ। দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পুরোধা হয়ে ১৯২১ সালে যাত্রা। যাত্রা পথে এই বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করেছে অসংখ্য রথী-মহারথী। দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য শিক্ষাবিদের সান্নিধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস হয়েছে সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর। ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, গণ-অভ্যুত্থান কিংবা মুক্তিযুদ্ধে দেশের ক্রান্তিলগ্নে বরাবরই পাশে থেকেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। লড়াইয়ে সামনে থেকে বুক চিতিয়ে লড়েছে। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হটানোর আন্দোলনেও জেগেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসবই অতীত ইতিহাস।

আন্দোলন-সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালনের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্দ্বিধায় বাহবা পাওয়ার যোগ্য। আশা করি বাহবা দিতে কেউই কুণ্ঠিত হবেন না। তবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে কি আন্দোলন-সংগ্রামের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার্য? অবশ্যই না। অথচ আন্দোলন-সংগ্রামের দিনগুলোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান নিয়ে আমরা বরাবরই আত্মশ্লাঘায় ভুগি। বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চারণভূমি। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুটা হয়েছিল গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবেই।

স্বাধীনতা-পরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা নিয়ে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদেরা বরাবরই উষ্মা প্রকাশ করেন। এককালে যে বিশ্ববিদ্যালয় বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের পুরোধা ছিল, হঠাৎ কেন খেই হারিয়ে ফেলল! কোথায় গলদ?
গলদ খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলোর কথা কারও অজানা নয়। সমস্যার কথা এলে অবধারিতভাবেই অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে চলে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের অপ্রতুলতার কথা প্রথমেই চলে আসে। প্রতিবছর বাজেটের সিংহভাগ চলে যায় শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বেতন-ভাতার পেছনে। গবেষণা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ তো আরও করুণ। গবেষণার রুগ্‌ণ দশা আমাদের ভুলিয়ে দিতে বসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মপ্রকাশ হয়েছিল গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সিলেবাস প্রণয়নে বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। বছর বছর একই সিলেবাসে চলছে পাঠদান। এ তো গেল ভাসা ভাসা কিছু মৌলিক সমস্যার কথা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন সমস্যার কথা কে না জানে! প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর আমার এক বন্ধুর কথাই ধরা যাক। আমার বন্ধু ভেবেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আলাদা এয়ার কন্ডিশনড রুম পাবে, পড়াশোনার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। আশার গুড়ে বালি। তার এই বাড়াবাড়ি আমাদের বন্ধুমহলে হাসির খোরাক জোগানো বৈ বাড়তি কিছু করতে পারেনি। আবাসন ব্যবস্থার কি করুণ দশা; এক রুমে গাদাগাদি করে থাকার কথা চিন্তা করতে পারেন? ক্যানটিনের খাবারের নিম্নমান, পরিবহন সংকট, রেজিস্ট্রার বিল্ডিংকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কাজে সময়ক্ষেপণ—এসব তো আছেই। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য নেই কোনো আধুনিক লাইব্রেরি সুবিধা; নেই হলে ভালোভাবে পড়ার ব্যবস্থা। বছর বছর বিভাগের সংখ্যা বাড়িয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পড়েছে জনারণ্যের ভাগাড়ে। প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীর পদভারে ন্যুব্জ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এত শিক্ষার্থীর আবাসন সংকটের কথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অজানা নয়। তবুও প্রতিবছর বাড়ানো হচ্ছে বিভাগের সংখ্যা, ফলে অবধারিতভাবে বাড়ছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এত সব সংকটে শিক্ষার্থীরা চিরে চ্যাপ্টা হওয়ার জোগাড়।

আলোচনা কি একপেশে হয়ে গেল?

না। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কোনোক্রমেই দায়মুক্তি দিচ্ছি না। শিক্ষার্থীরা নিজেরাও অনেক সমস্যার জন্য দায়ী। স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেন অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, আহমেদ শরীফ, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, হুমায়ূন আহমেদ, আহমেদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বের হচ্ছে না? হালের বিসিএস উন্মাদনা এর জন্য কম দায়ী নয়। সিস্টেমের মারপ্যাঁচে পড়ে বিসিএস এখন বহু আকাঙ্ক্ষিত চাকরি। অন্যদিকে, ক্যাম্পাস ভায়োলেন্স যেন স্বাভাবিক কোনো ঘটনা। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে জেঁকে বসেছে ক্যাম্পাস ভায়োলেন্স। বিশ্ববিদ্যালয়েরই একদল শিক্ষার্থীর হাতে মার খেতে হচ্ছে অন্যদল শিক্ষার্থীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বরূপ যেন এখানেই মূর্ছা যায়।

প্রতিবছর যখন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বের করতে হয় তলানি থেকে। উপরন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ পারলে তোপ দাগায় র‌্যাঙ্কিং কর্তৃপক্ষের ওপর। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে ঠিকঠাক তথ্য না থাকলে র‌্যাঙ্কিং কর্তৃপক্ষের কি-ই বা করার থাকবে। অর্থাৎ অজস্র প্রশ্নবোধক চিহ্ন এঁকে দাঁড়িয়ে আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রীতিমতো ধুঁকছে। সোনালি অতীত হারিয়ে যেতে বসেছে। মৌলিক জ্ঞান যেন বহুদূরের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর দায় অনেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে বর্তায়। যাঁরা পলিসি মেকিংয়ের সঙ্গে জড়িত, তারাই কেবল এর সমূহ সমাধান টানতে পারেন।

বর্তমান প্রজন্ম কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার ফিরে আসবে। আবার বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে, দ্যুতি ছড়াবে। তার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে পাড়ি দিতে হবে অনেকটা পথ।


*শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়