করোনার সঙ্গে বন্যা সুনামগঞ্জে

বন্যায় পানি উঠেছে ঘরবাড়িতে। লামাহাটি এলাকা, দিরাই উপজেলা, সুনামগঞ্জ, ৩ জুলাই। ছবি: লেখক
বন্যায় পানি উঠেছে ঘরবাড়িতে। লামাহাটি এলাকা, দিরাই উপজেলা, সুনামগঞ্জ, ৩ জুলাই। ছবি: লেখক

শেষ আশ্রয়ের জায়গাটিও চলে গেছে পানির নিচে। ছেলেমেয়ে নিয়ে কোথায় উঠব, কী–ইবা খাব বুঝে উঠতে পারতেছি না। ভাইরাসের কারণে অনেক দিন ধরেই কাজ নেই। কিছু সবজি চাষ করছিলাম। এগুলোও বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। আমার আর বাঁচার উপায় নেই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম।

সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তেতৈয়া গ্রামের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম। শহরের একটি কারখানায় কাজ করে চালান ছয় সদস্যদের পরিবারের ভরণপোষণ। করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়ে চলে আসেন গ্রামে। এলাকায় কিছু না পেয়ে নিজেই শুরু করেন সবজির চাষ। ফলন ভালো হওয়ায় আশার আলো দেখছিলেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু বন্যায় তলিয়ে গেছে তাঁর শেষ সম্বলটুকুও। বাড়িতে হাঁটুপানি। থাকার জন্য অন্য কোনো উঁচু জায়গা খুঁজছেন। একদিকে করোনাভাইরাস আর অন্যদিকে বন্যার কবলে পড়ে দিশেহারা তিনি।

শুধু নুরুল ইসলামই নন, ভাটির দেশ সুনামগঞ্জের অধিকাংশ উপজেলার মানুষেরই প্রায় একই অবস্থা। ভারী বর্ষণ আর উজান থেকে ধেয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে অঞ্চলটিতে বন্যা দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়ে গেছে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, জেলার ১১টি উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের ৪৪ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

জেলার সুরমা, কুশিয়ারা, জাদুকাটা, কালনীসহ আশপাশের নদীগুলোর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত দুই দিনে পানির গতিবিধি কিছুটা কমলেও বন্যা পরিস্থিতি আরও কিছুদিন এমন থাকবে বলে মনে করছে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড।

বর্ষার শুরুতেই এমন আকস্মিক বন্যায় বসতবাড়ি ও দোকানপাটে ঢুকে পড়েছে পানি। ভোগান্তিতে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। রাস্তায় হাঁটুপানি, কোথাও আবার কোমর পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। অনেক অঞ্চলই হয়ে পড়েছে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

ছড়িয়ে পড়া করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যা। লামাহাটি এলাকা, দিরাই উপজেলা, সুনামগঞ্জ, ৩ জুলাই। ছবি: লেখক
ছড়িয়ে পড়া করোনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বন্যা। লামাহাটি এলাকা, দিরাই উপজেলা, সুনামগঞ্জ, ৩ জুলাই। ছবি: লেখক

পুকুর তলিয়ে যাওয়ায় খামারিদের মাছগুলো বের হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে গোখাদ্য। কৃষকের সবজিখেতগুলো চলে গেছে পানির নিচে। এমন অবস্থায় অঞ্চলটিতে ইতিমধ্যেই খাবার ও সুপেয় পানির অভাব দেখা দিতে শুরু করেছে। প্লাবিত হওয়া এলাকাগুলোর স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। এতে পানি দূষিত হয়ে বিভিন্ন রোগের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বানভাসি মানুষের স্বাস্থ্য চরম হুমকির মধ্য। চারদিক প্লাবিত হওয়ায় পরিবারগুলো শিশুদের নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন। পানিতে পড়ে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বড় রকমের কোনো দুর্ঘটনা।

করোনাভাইরাসের কারণে কাজ হারিয়ে এমনিতেই অনেকে অসহায় জীবনযাপন করছিলেন। এখন আবার বন্যায় প্লাবিত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন দেশের উত্তর–পূর্বের জেলাটির মানুষ।

ভাইরাস আর বন্যার ফলে অসহায় মানুষগুলো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় প্লাবিত হওয়া কিছু পরিবার বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও অধিকাংশই রয়ে গেছেন এর বাইরে। গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন পানিবন্দী মানুষগুলো।

ভাইরাস ও বন্যার ফলে অসহায় হয়ে পড়া এসব মানুষের জন্য সরকারি সহায়তাগুলো আরও বাড়ানো উচিত। এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বানভাসি এসব মানুষের কাছে দ্রুত ত্রাণসহায়তা পৌঁছে দেওয়া দরকার। সঙ্গে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।