শ্রদ্ধাঞ্জলি মুক্তিযোদ্ধা তাহের আহমেদ, আপনার মৃত্যু নেই

তাহের আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
তাহের আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

রাতে খবর এল তাহের আংকেল আর নেই। তখন রাত ১০টা। সাড়ে নয়টায় ঢাকার সামরিক হাসপাতালে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি। খবরটা শোনার পর ভীষণ খারাপ লাগল। তাহের আহমেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন। সত্য, নিষ্ঠার সঙ্গে জীবন যাপন করেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। মানুষের কল্যাণে আজীবন ছুটেছেন। স্বপ্ন দেখতেন, তাঁদের অর্জিত বাংলাদেশ তরুণেরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

২০১১ সালের শেষের দিকে যখন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে কাজ করতাম। তখন তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়। আমার স্বপ্নের কথা বলার পর পরই তিনি ব্যাপক উৎসাহে রাজি হলেন আমাদের সঙ্গে কাজ করার। তখন মুক্ত আসরের একেবার নতুন যাত্রা। প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। তারপর আমাদের সঙ্গে তিনিও ছুটতে লাগলেন। দিতে লাগলেন নানান পরামর্শ। কমিটি হওয়ার পর আমরা তাঁকে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব দিলে খুব স্বাচ্ছদে তা গ্রহণ করেন।

প্রথম আলো শেষ পৃষ্ঠায় ‘তোমাদের এ ঋণ শোধ হবে না’ কলামে তাঁকে নিয়ে লেখাটা প্রকাশের পর কী যে খুশি হয়েছিলেন। পত্রিকা থেকে লেখা কেটে কাঁচের ফ্রেমে বেঁধে আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘জানো, সাঈদ, আমার মা লেখাটা বারবার পড়েন আর দুচোখ দিয়ে ঝরঝর করে চোখের পানি ঝরান।’

তরুণদের সঙ্গে তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর
তরুণদের সঙ্গে তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবা অসুস্থ ছিলেন। ঢাকার বাসাবোর বাড়িতে মাসহ তাঁরা সাত ভাইবোন থাকতেন। দেশে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ। টগবগে ঢাকা কলেজেপড়ুয়া তরুণ কি আর ঘরে বসে থাকতে পারেন? প্রতিজ্ঞা করলেন, কিছু একটা করতেই হবে। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকলেন। বড় ভাই তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে বকাবকি করলেন। দমে গেলেন না তিনি। মা বুঝতে পেরে একদিন ১০০ টাকার দুটি নোট বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন, ‘যাও, আমরা বুঝি শেষ হয়ে গেলাম।’ মায়ের কথা শুনে মনে শক্তি নিয়ে ভারতের উদ্দেশে বের হলেন।

ভারতে যাওয়ার পর তাহের আহমেদ প্রথম বাংলাদেশ ওয়ার কোর্সে যোগ দেন। সেখানে ছিল তাঁর বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ কামাল । দুজনে মধ্যে ছিল মধুর সম্পর্ক। প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করেন ১১ নম্বর সেক্টরের ঢালু সাব-সেক্টরে। ঢালু সাব-সেক্টরের একটি কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন তিনি। বুরেরচর, নকলা, তেলিখালীসহ আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নেন। মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও বীরত্বের জন্য তাঁকে বীর প্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।

স্বপ্ন ৭১ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর
স্বপ্ন ৭১ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর

২.
২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ত্রৈমাসিক স্বপ্ন ’৭১ বের করব। লেখা সংগ্রহ করা শেষ। সম্পাদনাও চলছে। কিন্তু প্রকাশ করা জন্য আমাদের অর্থ নেই। তিনি আমাদের অবস্থা দেখে নিজেই তাঁর পরিচিত বন্ধুদের ফোন করে পত্রিকাটি প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন। ধারাবাহিকভাবে কয়েকটি পর্ব নিজেও লেখেন। অনেক স্মৃতি এখনো যেন জ্বলজ্বল করে ওঠে। উত্তরার বাসায় আমরা দলবেঁধে যেতাম। সেখানে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মিটিং করে একসঙ্গে খেতাম। কী যে আতিথেয়তা।

পরিকল্পনা শেষ হতো না। আমরাও ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করতাম। ঢাকার আশুলিয়ার নন্দনে পার্কে আমরা আয়োজন করব ‘মুক্তির মেলা ও বিজয় উৎসব’। আমাদের সহ–আয়োজক প্রথম দিকে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। আংকেল বেশ জেদি ছিলেন। বলেন, দেখি কী হয়। তিনি নিজেই ছুটলেন। নিজের গাড়ি নিজেই চালিয়ে যেতেন। যখন সময় দিতেন, তখনই হাজির হতেন। শেষমেশ রাজি হলেন। নন্দনে অনেক বড় আয়োজন আমরা করলাম।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন মুক্ত আসরের এক অনুষ্ঠান শেষে কর্মীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সংগঠন মুক্ত আসরের এক অনুষ্ঠান শেষে কর্মীদের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা তাহের আহমেদ। ছবি: মুক্ত আসর

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তরুণদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা সেখানে অনুষ্ঠান করব। আংকেল আমাদের সঙ্গে থাকবেন। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ বাসা থেকে তাঁর গাড়িটা চুরি হয়ে যায়। তিনিও কিছুটা থমকে গেলেন। তবে আমাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হতো। বলতেন, গ্রামে একটা বাগানবাড়ি করব। সেখানে দূর-দূরান্ত থেমে মানুষজন আসবে। এখানে এসে ইতিহাস জানে পারবে। আমি আশপাশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ছেলেমেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা বলব। এমনকি মাদ্রাসায় যারা পড়ে, তারা এখানে এসে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানবে। এমন কত কথা।

বাগানবাড়ির গাছপালা, ফুল, প্রাণীগুলো দিন দিন বড় হতে লাগে। তারও নানা চিন্তা কাজ করতে লাগে। স্বপ্ন ’৭১–এর নামটা তাঁর এত পছন্দ ছিল যে তিনি তাঁর বাগানবাড়িটির নাম রাখেন ‘স্বপ্ন ৭১ বাগানবাড়ি’। কতবার যেন বলেছেন মুক্ত আসরের সবাইকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমরাও যাব যাব করে আর যাওয়া হলো না। তিনি আমাদের রেখে চলে গেলেন। রেখে গেলেন আমাদের কাছে সহস্র স্মৃতি আর কর্মময় জীবন। যে ঋণ আমরা কোনো দিন শোধ করতে পারব না। তিনি আমাদের কাছে থাকবেন আজীবন বিনম্র শ্রদ্বায়।

*প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ‍মুক্ত আসর