ভালো নেই গ্রামের বাসিন্দারা

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের জনসংখ্যার সিংহভাগ বসবাস করে গ্রামে। গ্রাম-পল্লি প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সৃষ্টিকর্তার অপরূপ নিদর্শনগুলোর একটি। ‘God made the village and man made the town’ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তাই এই কথাটি বেশ জনপ্রিয়। প্রকৃতির কোলে আশ্রিত গ্রামের মানুষের জীবন ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছে, যা শুধু উপলব্ধি করা যায়, সমাধানের পথ দীর্ঘ। একসময় গোলাভরা ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ প্রভৃতি বিষয় এখন গল্প কবিতা ছাড়া আর কিছুই না। আমাদের শ্যামল রূপ বাংলা বা বাংলাদেশ বলতে যে শ্যামলিমা বোঝায়, সেখানে আজ নানা রকম সমস্যা বিরাজ করছে, যা আগেও ছিল কিন্তু উদাহরণ দেওয়ার মতো নয়। কিছু কিছু সমস্যা দৃশ্যমান যা গ্রামের মানুষের ভালো না থাকার জন্য যথেষ্ট নয় কিন্তু এসব সমস্যার উৎসই গ্রামের মানুষের জীবনে অদৃশ্য ছায়ার রূপ—

রোগবালাই ও মহামারি-সংক্রান্ত ব্যাপারে অজ্ঞ ও অসচেতন
গ্রামে বসবাসরত মানুষজনের বেশির ভাগেরই রোগবালাই ও করোনার মতো মহামারির ব্যাপারে যথেষ্ট জ্ঞান ও সচেতনতার দীনতা রয়েছে। তাদের মধ্যে সচেতনতার ছিটেফোঁটাও পরিলক্ষিত হয় না। বাইরে বেরোলে মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বিভিন্ন মাধ্যমে বলা হলেও তারা তা মানছে না। এর ফলে বৃদ্ধি পাচ্ছে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি। স্বাস্থ্যবিধি না মেনে ‘আল্লাহ রক্ষা করবে’ নামক বাক্য বলে আল্লাহকে তারা পরীক্ষায় ফেলছে। অথচ আল্লাহ মানুষের পরীক্ষা নেন, মানুষ আল্লাহর পরীক্ষা নেওয়ার এখতিয়ার রাখে না।

রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক প্রভাব
করোনা মহামারির কারণে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট গ্রামের মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে মানুষের জীবনযাত্রার মান কমে যাচ্ছে। অনেকে দিনে দুমুঠো ভাত জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে গ্রামের মানুষ উৎপাদন করতে পারছে না। এর ফলে গ্রামের মানুষ শহরমুখী হচ্ছে।

এনজিওগুলোর কিস্তি নামক শোষণ
বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনজিও গ্রামের মানুষের পাশে দাঁড়ালেও সেই এনজিও এখন গ্রামের মানুষের শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। এনজিওগুলো যে পরিমাণ ঋণ দিচ্ছে সেই টাকা দিয়ে বর্তমান বাজারে কিছু করা সম্ভব নয়। তাই কিস্তি নামের উচ্চ সুদের বোঝা গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবার বহন করে যাচ্ছে।

কন্যাসন্তানদের নিয়ে অন্তঃসারশূন্য চিন্তাভাবনা

গ্রামের বেশির ভাগ অভিভাবক তাঁদের কন্যাসন্তানদের কোনো মতে বিয়ে দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলেই বুঝি হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। তাই বেড়ে যাচ্ছে বাল্যবিবাহের মতো ঘটনা। অনেকে আবার কন্যাসন্তান জন্ম নেওয়ার পর থেকেই তার বিয়ের জন্য অর্থ জমাতে শুরু করেন। কিন্তু মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা না জমিয়ে সেই টাকা দিয়ে তাদের পড়াশোনা শেখানোটা জরুরি। তাহলে মেয়েকে নিয়ে আর উদ্বিগ্ন হতে হবে না। সে নিজেই নিজের জীবনকে সাপোর্ট দিতে সক্ষম হয়ে উঠবে।

সুদ নামের বিষধর সাপের ছোবল
গ্রামে প্রায় ৯০ ভাগ পরিবার সুদের সঙ্গে জড়িত। এখন গ্রামের মানুষের মানসিক অবস্থা এরূপ দাঁড়িয়েছে যে বিপদে পড়লে টাকা দিয়ে কেউ কাউকে সাহায্য করবে না। কিন্তু সুদ দেওয়ার জন্য লোকের অভাব নেই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধানের ওপর সুদ নিচ্ছে এবং দিচ্ছে। তা ছাড়া প্রতি হাজারে ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত এবং এককালীন সুদ গ্রামের মানুষের জীবনকে এলোমেলো করে দিচ্ছে।

আধুনিক শিক্ষার অপ্রতুলতা
গ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভালো শিক্ষক, আধুনিক শিক্ষা ও শিক্ষা উপকরণ না থাকার কারণে গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা প্রতিযোগিতার যুগে পিছিয়ে যাচ্ছে এবং শহরের সঙ্গে টিকতে না পারা বা জিপিএ-৫ বেড়ে যাওয়ার কারণে ভালো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হতে পেরে সাধারণ কলেজে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ছে।

এ ছাড়া গ্রামবাংলায় মাদকের অভয়ারণ্য, বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি ও পরকীয়া, নদীমুখে বাঁধ ও উত্তর অঞ্চলে মরুকরণ, দ্রব্যমূল্য, সার ও কৃষিপণ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সমস্যায় উপদ্রুত জনজীবন।

বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চল অফুরন্ত সৌন্দর্যে ভরপুর এক অপরূপ লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সবুজ শ্যামলীমায় শোভিত আমাদের গ্রামাঞ্চলগুলো। আমাদের দেশের চালিকা শক্তির অন্যতম উৎস গ্রামাঞ্চল। সুতরাং এই গ্রামাঞ্চল ও এখানে বসবাসরত মানুষদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বজায় রাখাকে অবজ্ঞা করলে চলবে না। গ্রামের সরল-সোজা মানুষগুলোর জীবনকে ছোট ছোট সমস্যাগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। সেটা তাদের অজান্তেই। সব স্থানে অবিশ্বাস আর দলীয়করণ। গ্রাম বাঁচলে দেশ বাঁচবে। দেশ বাঁচলে আমরা ভালো থাকব। তাই গ্রামের মানুষের জন্য আমাদের একটু ভাবনার দরকার এখনই। কারণ আমার আপনার নাড়ি যে গ্রামে পাকা ধানের ফাঁকে। আকাশের সঙ্গে যে মেঠো পথ মিশে গেছে সে পথে...।


*শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়