এভাবে বেঁচে থাকা এ আশায় যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে

পুরো পৃথিবী আজ অদ্ভুত চিত্র দেখাচ্ছে। সকালবেলা দরজার নিচে এখন আর তাজা পত্রিকাটা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। ঘুম ঘুম চোখে যখন নাশতার টেবিলে যাই বাবাকে দেখি না আজকের তাজা খবরের দিকে গভীর মনোযোগ দিতে। এলাকার মোড়ের দোকানটার পাশ দিয়ে যখন যাই, এখন আর সেই ভাজা পরোটার সুবাস পাই না।

বাসায় ছিলাম অনেক দিন, কিন্তু জীবিকার তাগিদে এখন আমরা সবাই ছুটছি, বাঁচতে হবে। এত দিন ঘরে ছিলাম কিন্তু এই বাঁচার গন্তব্যে। জীবনটা যে সুন্দর, এটা আমরা বুঝতে পারি মরে যাওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে।

শুক্রবার (৩ জুলাই) ঘুম থেকে একটু দেরি করে উঠলাম। মা ইদানীং খুব অল্পতেই রেগে যায়, যাকেই সামনে পায় বকতে থাকে। দাদির ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলাম দাদি জানালা দিয়ে আকাশ দেখছে। দরজায় টোকা দিতেই দাদি ঘুরে তাকাল। একটু হেসেই বলল, ‘কি রে দাদু, আজ অফিসে যাস নাই?’ দাদির কাছে প্রতিদিনই হলো এই চার দেয়াল। আকাশে কী দেখো? জিজ্ঞেস করতেই লজ্জা পেল, বলল, ‘দাদু একটা দিন বেঁচে থাকাই আমার জন্য আলহামদুলিল্লাহ। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে আল্লাহকে ধন্যবাদ জানাই।’ দাদিকে আকাশ দেখার সুযোগ দিয়ে ঘর থেকে বের হতেই ভাইয়ের পিচ্চিটা কাছে এসে জড়িয়ে ধরল। ও আমাদের ঘরটা মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। কিন্তু ইদানীং বাবুটা এত মন খারাপ করে থাকে, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে বসল, ‘আচ্ছা ফুপ্পি, আমরা পাখি হলাম না কেন? তাহলে তো আর আমাদের করোনা হতো না, বাসায়ও থাকতে হতো না, আকাশে উড়ে উড়ে আমি ঘুরতে যেতে পারতাম।’ তখনই দাদির কথা মনে পড়ল। এখন সব বয়সের মানুষই আকাশ দেখে দিন কাটায়, আকাশটাকে মনের ক্যানভাস বানিয়ে আঁকিবুঁকি করে সব বয়সের মানুষই।

টুপ টুপ করে বৃষ্টি আজকে পড়ছেই, অফিস থেকে বের হয়ে এখন আর কপোত-কপোতিদের হাত ধরে হাঁটা দেখতে পাই না। রিকশার হুট তুলে রহমত আংকেল বাজার নিয়ে ঘরে ফিরছেন, চোখজুড়ে ভয়। তাঁর কাছে বৃষ্টি আজ বিরক্তিকর। রিকশাচালক মামা বাসার কাছে এসেই বলল, ‘মা ১০ টাকা বাড়ায় দেবেন, সবজির দাম এখন আর ৫০ টাকার নিচে নাই, করোনারে ডরাই না আমরা, আমাদের করোনা মারব না, না খাইয়াই মইরা যামু আমরা।’ তাহলে মাস্ক পরেছেন কেন আপনি? আপনি তো করোনাকে ভয় পান না। ‘পুলিশের ডরে মা, মাস্ক না পরলে রিকশা নিয়া বাইরালেই পুলিশ ঝামেলা করে, ভাত তো খাওন লাগব।’ টাকাটা দিয়ে চলে আসব, রিকশাচালক মামার চলে যাওয়া দেখতে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে ছুটছে তার অন্য গন্তব্যের দিকে যদি ১০ টাকা বেশি পায়। আকাশ দেখে না, তার ইচ্ছে করে না পাখি হয়ে আকাশে উড়তে। ঝুমবৃষ্টিতে এক কাপ ব্ল্যাক কফি হাতে নিয়ে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুনতে যখন জানালার পাশে দাঁড়াই, জানালার ওপাশে ঠিক তার ভিন্ন চিত্র, কাকের চেয়ে এখন পাখির কলতান শোনা যায় বেশি, সারা দিনের বৃষ্টিতে ভিজে গাছের পাতাগুলো আরও সবুজ হয়ে গেছে।

ইদানীং ফেসবুকে লগইন করতে কেন যেন ভালো লাগে না। যা-ই হোক, সবাই সবাইকে ভালো রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত। ফেসবুকে গিয়েই দেখলাম, ২৩ বছরের এক মেয়ে অজানা কারণে আত্মহত্যা করেছে। খুব জানতে ইচ্ছে করল তার কষ্টটা, তার কি আমার ভাইয়ের পিচ্চিটার মতো আকাশে উড়তে ইচ্ছে করে না। সে কি ভাবেনি এই করোনার সময়ও অনেক মানুষ আছে ১০ টাকা বেশি পাওয়ার মধ্যেই জীবনের সুখ খুঁজে পায়। জীবন তো একটাই। আমরা সবাই প্রতিদিন বেঁচে থাকি এই আশায় যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।