প্লেব্যাক সম্রাটের জীবনাবসান

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: সংগৃহীত

২০২০ যেন এক হারানোর বছর। একের পর এক কিংবদন্তির মৃত্যুতে শোকাহত পুরো জাতি। এবার সেই চিরবিদায়ের তালিকায় নাম লেখালেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। তাঁর গান মাতিয়ে রেখেছিল পুরো জাতিকে। দীর্ঘ ১০ মাস মরণব্যাধি ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন এন্ড্রু কিশোর, বাংলাদেশের মানুষের কাছে যিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ নামেই ছিলেন অধিক পরিচিত।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে এন্ড্রু কিশোরের জন্ম। বেড়ে ওঠাও এই শহরে। পরবর্তী সময়ে পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন সংগীতের প্রতি অনুরক্ত।

এন্ড্রু কিশোরের গানের ভুবনে পথচলা শুরু আবদুল আজিজ বাচ্চুর হাত ধরে। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে তিনি ছিলেন রাজশাহী বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, দেশাত্মবোধক গানসহ প্রায় সব ধরনের গানই করতেন তিনি। শ্রোতাদের কাছে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন এক জনপ্রিয় নাম। রাজশাহী বেতারের এই শিল্পীই যে একদিন বাংলা গানকে নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেবেন, সে কল্পনা এন্ড্রু কিশোর নিজেও হয়তো করেননি।

সংগীতশিল্পী হিসেবে একক অ্যালবাম প্রকাশের দিকে মন ছিল না তাঁর বরং সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন চলচ্চিত্র জগৎকে। আর তাই তো তাঁরই হাত ধরে বাংলা চলচ্চিত্রে সূচিত হয়েছে সংগীতের নতুন ধারা। ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা’, ‘তুমি যেখানে, আমি সেখানে’ কিংবা ‘এখানে দুজনে নিরজনে’র মতো গানগুলো এখনো মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এন্ড্রু কিশোরের যাত্রা শুরু। শুরুর দিকে তাঁকে সবাই না চিনলেও দুই বছর পর ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ গানটি দিয়েই বাজিমাত করেন তিনি। এরপর তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক শ্রুতিমধুর গান দিয়ে মাতিয়ে রেখেছেন শ্রোতাদের। বাংলাদেশের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও তাঁর যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ‘ইত্যাদি’র দর্শকদের কাছে এন্ড্রু কিশোর ছিলেন একজন প্রিয়মুখ।

সারা জীবন গান নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। প্লেব্যাক আর স্টেজ শোর কাজ তাঁর কাছে ছিল নেশার মতো। কিন্তু এরই মাঝে শরীরে বসত বাঁধে মরণব্যাধি ক্যানসার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে যান তিনি। সেখানেই দীর্ঘদিন ধরে তাঁর চিকিৎসা চলছিল। মাঝে শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও সামগ্রিক উন্নতি দেখা যাচ্ছিল না। এন্ড্রু কিশোর নিজেও দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন, যার ফলে জুন মাসেই তাঁকে দেশে আনা হয়। কয়েক দিন ধরে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে আরও বেশি। অবশেষে আজ সন্ধ্যায় জন্মভূমি রাজশাহীতেই তিনি পরলোকগমন করেন।

এন্ড্রু কিশোরের গান মানুষকে আলোড়িত করেছে, কখনো আনন্দ দিয়েছে, কখনো-বা ভাসিয়েছে দুঃখের সাগরে। তাঁর একটি গানের শুরুর লাইনটি ছিল, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’। এন্ড্রু কিশোরও ভালোবাসা চেয়েছিলেন, এই ভালোবাসা পেয়েছিলেনও তাঁর লক্ষাধিক গুণমুগ্ধ শ্রোতার কাছে। এই ভালোবাসাই তাঁকে বাংলাদেশের বুকে অমর করে রাখবে।


*শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়