সুরের আকাশে বিচিত্র ভুবনে আর দেখা যাবে না এন্ড্রু কিশোরকে

এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো
এন্ড্রু কিশোর। ছবি: প্রথম আলো

প্রিয় মানুষগুলোর চিরবিদায়ে আস্তে আস্তে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের ভিতটুকু ছোট হয়ে আসছে। যাঁর গানগুলো মনকে ছুঁয়ে যেত, তাঁর কণ্ঠটি আর জাগরুক হয়ে থাকবে না। স্মৃতির পাতা স্মৃতিময় কাব্যের ধারায় আরও প্রসারিত হলো! চিরকাল নিস্তব্ধতায় রয়ে যাবে তাঁর নাম। কঠিন সময়ের মধ্যে যাঁর গানগুলো মনকে প্রশান্তি এনে দিত, যাঁর গানগুলো অসীম মমত্ববোধে বারবার শোনার চেষ্টা করতাম, তিনি আমাদের মাঝ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন! সংস্কৃতি অঙ্গন থেকে আরও এক নক্ষত্রের চলে যাওয়া মানে বিষণ্ন মনকে আরও বিষণ্নতায় নিমজ্জিত করে রাখা!

বরাবরই আমি গানপ্রিয় মানুষ। তাঁর গানগুলোর মধ্যে একধরনের ভালো লাগার নান্দনিক অনুভূতি কাজ করত। তাই, ছোটবেলায় স্কুল থেকে ফিরে বিকেলবেলা ঘুমোতে যাওয়ার আগে ‘রেডিও’ নামের যন্ত্রটা সঙ্গে রাখতাম। ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি’ আয়োজনেও তাঁর শ্রুতিমধুর কণ্ঠে গান শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। কোনো দিন শুনতে না পেলে মনে আনন্দটুকু খুঁজে পেতাম না। এখন আর রেডিও নেই। তাই অনেক দিন ধরে শুনতে পাই না মধুমাখা কণ্ঠের শ্রুতিমধুর গান। ছোটবেলার তালটুকু হারিয়ে ফেলি নিঃশব্দতায়।

আমি কিছু লিখতে চাইনি। কিন্তু বারবার ভেসে আসছিল চিরচেনা স্বরের সুন্দর মুহূর্তগুলো। তাই প্রিয় কণ্ঠস্বরের নিবৃত্তি হওয়ায় কিছুটা লিখতে বসেছি।
শৈশবে যাঁর গান না শুনলে সংস্কৃতিতে অভাববোধ থেকেই যেত, তাঁর লালিত্য কণ্ঠে গান শুনতে মনটুকু ভরিয়ে রাখত। বস্তুত সংগীতপ্রেমীদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে চিরকালের জন্য স্থান করে রেখেছে তাঁর গাওয়া গানগুলো।

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্ম। মা মিনু বাড়ৈ এবং বাবা ক্ষিতীশ চন্দ্র বাড়ৈ। মায়ের গানের প্রিয় শিল্পী ছিলেন কিশোর কুমার। তাই মায়ের কোলে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে শিশুটির নামকরণ করা হয় প্রিয় শিল্পীর নামে অর্থাৎ কিশোর। মূল নাম এন্ড্রু কিশোর কুমার বাড়ৈ। পরবর্তী সময়ে সংগীত জগতে এন্ড্রু কিশোর নামেই পরিচিতি লাভ করেন। স্কুলশিক্ষক মায়ের সঙ্গেই স্কুলে আসা-যাওয়া। তারপর কলেজজীবনে রাজশাহীতে পড়াশোনা চালিয়ে যান। বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে নিজ শহর অর্থাৎ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। রাজশাহী সিটি কলেজে পড়ার সময়ই গান গেয়ে সেখানে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। আস্তে আস্তে নিজের জীবনকে সংগীতের সঙ্গে নিবদ্ধ করেন। মহিমান্বিত হয়ে ওঠেন নিজের কণ্ঠস্বরের গানগুলো গেয়ে। সংগীত বিষয়ে হাতেখড়ি শুরু হয় রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। তারপর আস্তে আস্তে ক্লান্তিময় জীবনে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত কণ্ঠশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলেন।

মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত শিল্পী হন। তখন থেকেই বিভিন্ন ধরনের গান গেয়ে যান। প্রকৃতপক্ষে সংগীতের প্রতি মোহের নিবিষ্টতাই এন্ড্রু কিশোরের শিল্পীসত্তার গুণাগুণ প্রকাশের ঐশ্বর্য বজায় থাকে। শিল্পীসত্তার মধ্যে নান্দনিকতার মিশেল ঘটিয়েছেন বলেই বিভিন্ন সময় রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, দেশাত্মবোধক, লোকগীতি, আধুনিক গান গেয়ে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন নিজেকে!

চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে দেশবরেণ্য সুরস্রষ্টা ও সংগীত পরিচালক আলম খানের হাত ধরে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। তবে প্রথম যে গান শুনে দর্শকপ্রিয়তা লাভ করেন সেটি হলো ‘এক চোর যায় চলে’। সেখানে তাঁর ক্যারিয়ারের বিশেষ মুহূর্তে মোড় ঘুরিয়ে দেয়। আধুনিক ও কালজয়ী অনেক গান গেয়ে বাংলাদেশের গানের জগৎ সমৃদ্ধ করে রেখেছেন। চলচ্চিত্রে প্রায় ১৫ হাজার গানে কণ্ঠে দিয়েছেন। তিনি ‘প্লেব্যাক সম্রাট’ হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেন।

কতটুকু শিল্পীসত্তার গুণাগুণ থাকলে একজন শিল্পী সব ধরনের গান গেয়ে যেতে পারেন, ওনার কাছ থেকে বুঝতে পারি। সবক্ষেত্রেই বিচরণ করেন অতি সহজেই। রোমান্টিক থেকে বেদনার—সব ধরনের গানের ক্ষেত্রেই বিচিত্রতায় ভরপুর হয়ে ওঠে তাঁর কণ্ঠস্বর। সে জন্যই তাঁর মধুমাখা কণ্ঠের গান ‘ওগো বিদেশিনী তোমার চেরিফুল নাও’ কিংবা ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইব না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে’ গানগুলো আজও মনকে মাতিয়ে রাখে।

বৈচিত্র্যের আভাস দেখতে পাওয়া যায় রোমান্টিক গানের মধ্যেও, যার ফলে শ্রোতাদের মন কেড়ে নেয় অতি সহজেই। বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠার একটি অন্যতম কারণ প্রেমের গানে রোমান্সের অবয়ব। তাইতো গ্রাম বাংলায় ‘কী যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা থাকতে পারি না ঘরেতে’ গানটি সমভাবে সমাদৃত।

‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’ গানটির মধুময়তা ফিরে আসে সত্যিকারের দ্যোতনায়। কিংবা ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানটির রোমান্স ধরা দেয় গ্রাম-বাংলার মানুষের মাঝে। অন্যদিকে ‘কী যাদু করিলা পিরিতি শিখাইলা’ এবং ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’ ‘প্রাণসজনী’ চলচ্চিত্রে এক নতুন অবয়ব এনে দেয়। যার ফলে আমাদের প্রাণের অবারিত সৌন্দর্যে বারবার ধরা দেয় সুন্দর গানগুলোর প্রিয় মুহূর্ত। গানগুলো শ্রোতাদের মাঝে বিপুলভাবে সাড়া ফেলে।

দীর্ঘদিন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে দুই বাংলায়ই গান করেছেন এন্ড্রু কিশোর। একের পর এক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়ে শ্রোতাদের মন কেড়ে নেন নিমিষেই। সে জন্যই আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিলো’, ১৯৮৭ সালে ‘সারেন্ডার’, ১৯৮৯ সালে ‘ক্ষতিপূরণ’, ১৯৯১ সালে ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ১৯৯৬ সালে ‘কবুল’, ২০০০ সালে ‘আজ গায়েহলুদ’, ২০০৭ সালে ‘সাজঘর বিজয়ী’, ২০০৮ সালে ‘কি যাদু করিলা’ সিনেমাগুলোর জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ গায়কের পুরস্কার লাভ করেন।

১৯৯৮ সালে ‘পদ্ম পাতার পানি নয়’ গানটির জন্য মেরিল- প্রথম আলো পুরস্কার লাভ করেন।

অগণিত মানুষের ভালোবাসার শিল্পী অসুস্থ হওয়ায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর গমন করেন। কিছুদিন পর জানা যায় তিনি ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত। সেখানে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছিলেন।

জীবনে অগণিত মানুষের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা পেয়েছেন। তাইতো চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে গমনের পর গেটওয়ে থিয়েটার হলে আয়োজন করা হয় ‘এন্ড্রু কিশোরের জন্য ভালোবাসা’ শিরোনামে সংগীতানুষ্ঠান। আয়োজন করে বাংলাদেশ চেম্বার এবং সিঙ্গাপুর বিজনেস সোসাইটি। কষ্টের সীমানা পেরিয়ে হুইল চেয়ারে বসেই গাইলেন ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’। আবেগে ভাসিয়ে দিলেন দর্শক ও শ্রোতাদের। নিজ দেশের পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে অনেকেই আপ্লুত হয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তিনি দেখতে পেয়েছেন তাঁর প্রতি মানুষের অগাধ ভালোবাসাটুকুর বিস্তৃতি। আঁচ করতে পেরেছেন নিজের মমত্ববোধের জায়গাটুকু থেকে। তিনি আমাদের ভেতর কতটুকু জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন, তা আমরা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে কিংবা সিঙ্গাপুরের সংগীতানুষ্ঠানের মাধ্যমেই আঁচ করতে পারি।

শরীরের অবস্থা বেশি ভালো যাচ্ছিল না বলে ১১ জুন সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে আসেন দেশে। নিজ শহর রাজশাহীর মহিষবাথানে শেষ হলো তাঁর জীবনের গল্প! তাঁর বোন ডা. শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে গত ৬ জুলাই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী এবং এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর অগণিত গানের ভক্ত।

এ বিস্ময়কর কণ্ঠরাজের জীবনাবসানে নেমে আসে শোক। গানের জলসাঘর থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন। রেখে গেলেন অজস্র সংগীতপ্রেমী, যাঁদের জীবনের জলসাঘরে তাঁর স্থান থাকবে অমলিন। চিরভাস্বর হয়ে বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে।

প্রিয় শিল্পীর একেকটি গান স্মরণ করিয়ে দেয় প্রিয় বস্তুর সান্নিধ্য কিংবা প্রিয় কোনো মুহূর্ত! তাঁর গানগুলোর মাঝেও খুঁজে ফিরি স্মৃতির অগোচরে ফেলে আসা সুন্দর মুহূর্তগুলো! তাঁকে হারিয়ে অসীম শূন্যতার মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে নেবে তাঁর গানগুলোর স্পর্শিত অনুভবে।

*ব্যাংকার ও লেখক