কিংবদন্তি এন্ড্রু কিশোরের সঙ্গে কিছুক্ষণ

অ্যান্ড্রু কিশোর
অ্যান্ড্রু কিশোর

দিনটি যে কী বার ছিল, ঠিক মনে নেই। খুব সম্ভবত শুক্রবার। তা শুক্র বা শনিবার, যা-ই হোক আমার জন্য সেদিন ছিল ঈদের দিন। সে সময় আমি থাকতাম রাজশাহীতে, গবেষণার কাজে। ২০১৬ সালের জুলাই মাসের কথা। আমার বাসাটি ছিল পদ্মা আবাসিক এলাকায়, ৮ নম্বর রোডে।

দুপুরটা গড়িয়েছে কেবল, ফিরলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দারোয়ান গেট খুলে দিল, মুখটা হাসিতে ভরা। তার মুখের হাসিটা আর থামে না! এমনিতেই হাসি-খুশি মুখ তার, কিন্তু সেদিনের হাসিটা যেন বিজয়ের হাসি। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। ‘ব্যাপার কী?’ ভাবলাম আমি। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী খবর মিরাজ?’ মিরাজ, দারোয়ানটির নাম। ‘ওদিকে তাকিয়ে দেখেন’, আমাকে বলল। হাসিটা তখনো ঝুলছে তার ঠোঁটে। পার্কিং এলাকাটা বেশ বড় আর সাজানো। বাড়িওয়ালা বেশ শৌখিন, সেই দিনটির সঙ্গে এর একটা সম্পর্কও আছে, কিছুক্ষণ পরে বুঝেছিলাম। আমি ওদিকটায় তাকালাম, মিরাজ যেদিকে তাকিয়ে। পার্কিং স্পেসটার পূর্ব দিকটাতে বসে আছেন উনি, দেখলাম, সঙ্গে অচেনা একজন। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। একটু এগিয়ে গেলাম সামনে, নিশ্চিত হওয়ার জন্য। নিশ্চিত হলাম, আর তখনই বুঝতে পারলাম মিরাজের হাসির মর্মার্থ। আমাদের দিকে তাকালেন উনি মানে এন্ড্রু কিশোর, বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী। আমার মুখেও মিরাজের হাসিটা প্রতিফলিত হলো, হয়তো খেয়াল করলেন। বললেন, ‘বসেন।’ পাশেই বসলাম, আরও কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার ফাঁকা থাকল তার পরও।

পরিচিত হলাম। ১৯৫৫ সালে জন্ম, বেড়ে ওঠাও রাজশাহীতে। তিনি জানালেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। কথোপকথনে বুঝলাম গলা সাধতে এসেছেন, কালকে একটা গানের অনুষ্ঠান আছে রাজশাহীতে। গলা সাধতে এখানে? এ ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে একটা অডিও রেকর্ডিং স্টুডিও আছে জানতাম, তবে এই স্টুডিওটি যে রাজশাহীর মধ্যে সবচেয়ে ভালো, তা প্রথম শুনলাম তাঁর মুখ থেকেই। অথচ প্রায় তিন বছর হলো এই বাসায় আছি। যার মর্ম যে বোঝে!

বাড়িওয়ালা যে শৌখিন, তা সত্যিই এবার নিশ্চিত হলাম। ‘দাদা, এখনো গলা সাধতে হয়? এই বয়সেও?’, আমি জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, ‘আমাদের প্রতিদিন-ই তো খেতে হয়, তাই না?’ রসিকতা করলেন। ‘গানগুলো কতবার গেয়েছি, তার পরও অনুষ্ঠানের আগে প্র্যাকটিস না করলে হয় না।’ নিজে থেকেই বললেন তিনি।

আমি বললাম, ‘সেই ছোটবেলা থেকেই আপনার গান শুনি, খুব ভালো লাগে।’ খুশি হলেন কি না, বুঝলাম না। সারা দেশের মানুষই তো তা-ই বলে! আমি কিন্তু খুশি করার জন্য বলিনি, মন থেকেই বলেছিলাম। তবে ওনার নাকের দুপাশে দুটো ভাঁজ স্পষ্ট হলো, হয়তো আমাকে নিরাশ করলেন না। একটু পর, ‘পিয়া’, বাড়িওয়ালার মেয়ে স্টুডিও থেকে বের হয়ে শিল্পীর কাছে এল। বলল, ‘দাদা আসেন, রেডি।’ চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে ভ্রু-যুগলে ইশারা করলেন আমার দিকে তাকিয়ে। যার অর্থ, ‘চলেন যাই স্টুডিওর ভেতর’, আমি বুঝতে পারলাম।

স্টুডিওর ভেতর ইনস্ট্রুমেন্টগুলো থেকে টুং, টাং, ঢুস-ঢাস শব্দ হচ্ছিল। ভেতরটায় হালকা আলো জ্বলছে, প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঢুকতেই ছেলেগুলো দাঁড়িয়ে পড়ল, ইনস্ট্রুমেন্ট বাজাচ্ছিল যারা। ‘বসো, বসো’, বলতে বলতে নিজেও বসলেন একটা চেয়ার টেনে। আমি বসলাম একটু দূরে। ছেলেগুলোকে ইনস্ট্রুমেন্ট বিষয়ে কী সব ইনস্ট্রাকশন দিলেন, আমি ওসব বুঝলাম না। পিঠে ঝোলানো ব্যাগ থেকে গানের খাতা বের করলেন শিল্পী, পাতা উল্টে-পাল্টে খুঁজতে লাগলেন জনপ্রিয় গানগুলো। তারপর একে একে গাইতে মানে গলা ঠিক করতে লাগলেন, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যখানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ ...।

দুই ঘণ্টা, কখন, কীভাবে চলে গিয়েছিল বুঝতে পারিনি। সেদিনই প্রথম দেখেছিলাম ওনাকে সামনাসামনি, অথচ মনে হয়েছিল কত দিন থেকে চিনি!

এন্ড্রু কিশোর আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সংগীত পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওতে তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। ১৯৭১ সালের পর তিনি নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান শ্রেণিতে রাজশাহী বেতারের সঙ্গে তালিকাভুক্ত শিল্পী। এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৭ সালে আলম খান সুরারোপিত ‘মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে। শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তিনি একাধিকবার পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কার এবং মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার।

২০২০ সালের ৬ জুলাই, ‘প্লেব্যাক সম্রাট’খ্যাত দেশবরেণ্য এই সংগীতশিল্পী মৃত্যুবরণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করেছিলেন, নন-হজকিন লিম্ফোমা নামের ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। ক্যানসার নির্মূল হয়নি, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করেও। চিকিৎসক হাল ছেড়ে দেওয়ায় ক্যানসার নিয়েই ৯ মাস পর ২০২০ সালের ১১ জুন দেশে ফেরেন প্রখ্যাত এই সংগীতশিল্পী। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজশাহীতে ছিলেন। মাত্র ৬৪ বছর বয়সে চলে গেলেন সবার প্রিয় শিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

‘কোন গানটা শুনতে চান?’ যদি প্রশ্ন করা হয় মুমূর্ষু আমাকে, বলব, ‘শোনাও, এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে “আমার বুকের মধ্যেখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে/ সেইখানে তোমাকে আমি রেখেছি কত না যতনে। তোমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে/ সেইখানে আমাকে রেখো আর কোথাও যাব না জীবনে।’

ওপারে ভালো থাকবেন দাদা, বাংলাদেশের কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী এন্ড্রু কিশোর।

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ