উইঘুরদের গোঙানির শব্দ কবে শুনবে বিশ্ব

উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকার কঠোর নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ আছে। ছবি: রয়টার্স
উইঘুর মুসলিমদের প্রতি চীন সরকার কঠোর নীতি অনুসরণ করছে বলে অভিযোগ আছে। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে আলোচনায় চীনে সংখ্যালঘু উইঘুর সম্প্রদায়ের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন। গত ১৮ জুন মার্কিন কংগ্রেসে চীনে উইঘুর নির্যাতন নিয়ে নিষেধাজ্ঞা-সংক্রান্ত একটি বিল পাস হয়েছে। এতে যে চীনের কিছু যায়-আসে না, তা কিন্তু খোদ চীনবিরোধীরাও জানেন। কারণ, দুই শক্তির কথা-বিবৃতির লড়াই অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। ইদানীং করোনা থেকে শুরু করে ট্রাম্প প্রশাসনের ভূমিকা খোদ হিংসাত্মক স্নায়ুপীড়নের জায়গা থেকে। কিন্তু উইঘুর মুসলিম অধিকার ইস্যুতে আমেরিকার অবস্থান আগে কোনো দিন দেখা যায়নি। ওআইসি সরব হয়ে কোনো দিন একটা বাক্যও খরচ করেনি।

যা-ই হোক, মূল কথা সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম অধিকার এক কথায় খুব মর্মান্তিক।

সম্প্রতি প্রকাশ হওয়া সবচেয়ে ভয়ংকর তথ্য হলো, উইঘুর ও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর নারীদের সন্তান জন্মদান নিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তাঁরা যেন জন্মদানের কোটা অতিক্রম না করেন, সে জন্য নারীদের গর্ভধারণ এড়াতে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

জেনজের প্রতিবেদনে বলা হয়, সেখানে নারীদের সর্বোচ্চ দুটি সন্তান জন্মদানের বৈধতা রয়েছে। যেসব নারীর সন্তানের সংখ্যা এর চেয়ে কম, তাদের জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধ গ্রহণে বাধ্য করা হচ্ছে। অনেক নারী জানিয়েছেন, তাঁদের স্টেরিলাইজেশন সার্জারি করাতে বাধ্য করা হয়েছে। বন্দিশিবিরের সাবেক বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাঁদের এমন ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, যেটি গ্রহণের পর তাঁদের পিরিয়ড বন্ধ হয়ে যেত বা অস্বাভাবিক রকমের রক্তক্ষরণ হতো। সাধারণত, জন্মনিয়ন্ত্রক ওষুধের ক্ষেত্রে এমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে জেনজ তার প্রতিবেদনে লেখেন, প্রত্যন্ত এলাকায় অবস্থিত কিছু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের বাধ্যতামূলক গাইনি পরীক্ষা দিতে হয় ও প্রতি দুই মাস অন্তর স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছ থেকে গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করাতে হয়।

অতীতের নির্যাতন অব্যাহত থাকার পাশাপাশি চীন অমানবিকভাবে করোনার লকডাউনের মধ্যেও উইঘুর মুসলিমদের জোরজবরদস্তিভাবে বিভিন্ন কলকারখানায় কাজে বাধ্য করছে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মাধ্যমে বিষয়টি নজরে আসে।

চোখ বন্ধ করে ভাবুন তো, সামরিক বাহিনীর লোকজন আমার আপনার ঘরে ঢুকে শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের গাড়িতে তুলে কসন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখছে। নিয়ম করে কাঠ, তারের চাবুক দিয়ে পেটানো, শরীরে সুই ফুটানো, প্লাস দিয়ে নখ তুলে নেওয়া। আশপাশের বাড়ি থেকে নির্যাতনের স্টিম রোলারে উইঘুরদের ব্যথা ও যন্ত্রণার আর্তনাদ শুনতে পেতাম। এমন বর্ণনা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কাছে একজন উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতিনিধির।

উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ছবি: রয়টার্স
উইঘুর সংস্কৃতি ও জাতিগত সত্তাকে মুছে ফেলার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ছবি: রয়টার্স

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান মিশেল ব্যাশেলেটও দাবি জানিয়েছিলেন শিনজিয়াংয়ের পরিস্থিতি দেখতে। পর্যবেক্ষকদের সেখানে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, উইঘুর লোকজনের ২৬টি কথিত ‘স্পর্শকাতর দেশে’ আত্মীয়স্বজন আছেন, তাঁদের এসব ক্যাম্পে আটকে রাখা হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, কাজাখস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া, মঙ্গোলিয়া, তুর্কমেনিস্থানসহ আরও কিছু দেশ। সংগঠনটি আরও ভয়ংকর যা বলছে, তা হলো, ‘যারা মেসেজিং অ্যাপ, হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে বিদেশের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন, তাঁদের টার্গেট করে কর্তৃপক্ষ।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো আরও বলছে, উইঘুর মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁরা (সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী) কথা বলতে পারেন না, কারণ তাঁরা ‘বোবা’। ২০১৮ সালের আগস্টে জাতিসংঘের একটি কমিটি জানতে পেরেছে যে ১০ লাখের মতো উইঘুর মুসলিমকে পশ্চিমাঞ্চলীয় শিনজিয়াং অঞ্চলে কয়েকটি কসন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দী করে রাখা হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বরাতে, এসব ক্যাম্পে তাঁদের ‘নতুন করে শিক্ষা’ দেওয়া হচ্ছে। কসন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পালা করে নির্যাতনের সঙ্গে জোর করে তাদের চীনা মান্দারিন ভাষা শেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, সি চিন পিংয়ের অনুগত থাকতে। সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং রোমহর্ষক তথ্য হলো, বন্দুকের নল বুক বরাবর রেখে তাঁদের নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস বদলের বিবেচনার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে এবং মুসলিম ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হচ্ছে। অ্যামনেস্টি ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েই যাচ্ছে সব সময় সি চিন পিংয়ের সরকার। ন্যক্কারজনকভাবে এটা মানতে ভীষণ নারাজ ও ক্ষোভ সি চিন পিংয়ের।

উইঘুরদের নিয়ে পুরো বিশ্বের কোনো মাথাব্যথা নেই। ছবি: রয়টার্স
উইঘুরদের নিয়ে পুরো বিশ্বের কোনো মাথাব্যথা নেই। ছবি: রয়টার্স

উইঘুর কারা

১৯১১ সালে মাঙ্কু সাম্রাজ্য উৎখাতের মাধ্যমে পূর্ব তুর্কিস্তানে চীনা শাসন চালু হয়। কিন্তু রক্তে মিশে থাকা স্বাধীনচেতা স্বভাবের উইঘুররা এই ঔপনিবেশিক শাসনের বশ্যতা মানেনি। সংগত কারণে ১৯৩৩ ও ১৯৪৪ সালে তারা দুবার চীনাদের সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের অনুকূলে ছিল না। এ কারণে ১৯৪৯ সালে আবারও তারা মাও সেতুংয়ের চীনা কমিউনিস্টদের হাতে পরাজিত হয়ে জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে পরিণত হয়। সেই সময় কমিউনিস্ট পার্টির গভর্নর ছিলেন মুসলিম সাইফুদ্দিন আজিজি। এর অনেক আগে মধ্যযুগে তাং সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ার পর থেকেই তুর্কিস্তানে ইসলাম ও আরবের প্রভাব বাড়তে থাকে। স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। উইঘুরকেই এখন চীনের মুসলিম জনগোষ্ঠী বোঝানো হয়। আবার চীনে মুসলমানদের হুইও বলা হয়। উইঘুরের বর্ণমালা আরবি। এ জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের।

ভৌগোলিক পরিচয়

মূলত, এরা স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তানের অধিবাসী। পূর্ব তুর্কিস্তান প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত মধ্য এশিয়ার একটি দেশ, যার চারপাশে চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশেই উইঘুর সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। সিআইএর ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্ট বুক অনুযায়ী, চীনের মোট জনসংখ্যার ১ থেকে ২ শতাংশ মুসলিম। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রতিবেদনে দেখা যায়, জিনজিয়াংয়ে মুসলিমরা চীনা জনসংখ্যার ১ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০০৯ সালের এক হিসাব অনুযায়ী, এসব দেশের মধ্যে চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের উইঘুর লোক বসবাস করে। কাজাখস্তানে ২ লাখ ২৩ হাজার, উজবেকিস্তানে ৫৫ হাজার, কিরগিজস্তানে ৪৯ হাজার, তুরস্কে ১৯ হাজার, রাশিয়ায় ৪ হাজার, ইউক্রেনে ১ হাজারের মতো উইঘুর লোক বাস করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকেও প্রাচীন এ সম্প্রদায়ের লোকদের উইঘুর না বলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে ডাকা হতো। মূলত, ১৯২১ সালে উজবেকিস্তানে এক সম্মেলনের পর উইঘুররা তাদের পুরোনো পরিচয় ফিরে পায়।

চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
চীনের জিনজিয়াংয়ে ১ কোটি ২০ হাজারের মতো উইঘুর লোক বসবাস করে। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

অর্থনৈতিক গুরুত্বজনিত আগ্রাসন-বিরোধ

উরুমকি বর্তমান জিনজিয়াংয়ের রাজধানী। জিনজিয়াং একটি প্রধান ফসল উৎপাদন কেন্দ্র। এখানে বিপুল পরিমাণ খনিজ ও তেলসম্পদ মজুত রয়েছে। ১৮৮৪ সালে কিং রাজত্বের সময় জিনজিয়াং চীনের একটি প্রদেশ হয়। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চীনা কমিউনিস্ট সেনারা জিনজিয়াংয়ে অভিযান চালান। এর সূত্রে চীনের হান সামরিক গোষ্ঠী জিনজিয়াংয়ে অভিবাসী হয়েছে। হান সাংস্কৃতিক আত্তীকরণের বিরুদ্ধে এবং সাংস্কৃতিক বিপ্লবের কারণে বহু মানুষ নির্যাতিত হয়। বিপুলসংখ্যক কাজাখ জনগোষ্ঠী পার্শ্ববর্তী কাজাখস্তানে পালিয়ে যায়। এরপর থেকে উইঘুর মুসলমানদের সঙ্গে চীনা কর্তৃপক্ষের বিরোধ সৃষ্টি হয়। একসময় তা রূপ নেয় সংঘর্ষে। গত শতাব্দীর শেষে উইঘুর মুসলমানেরা স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে।

ফ্রিডম ওয়াচের মতে, চীন হচ্ছে পৃথিবীর অন্যতম ধর্মীয় নিপীড়ক দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকায় এসব নিপীড়নের গোঙানির শব্দ দুনিয়াবাসী খুব একটা জানতে পারে না। কালেভদ্রে কিছু জানতে পারা যায়।

চীনের অন্তঃসারশূন্য বক্তব্য

উইঘুর মুসলমানদের বিরুদ্ধে বর্বরোচিত নীতির ব্যাপারে চীন বলে যে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় চরমপন্থা মোকাবিলা করার জন্য তারা নাকি নানা পলিসি নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু দাড়ি রাখা, রমজান মাসে রোজা রাখা কি করে চরমপন্থা হয়, তা বোধগম্য হয় না বিশ্ববাসীর।

মুসলিম দেশগুলোর চুপ থাকার কারণ

চীনের অর্থনীতির রমরমা অবস্থা এবং তাদের কাছ থেকে নানান সুবিধা পেয়ে বোবা হয়ে আছে অধিকাংশ মুসলিম দেশ। বুদ্ধিজীবীরাও কথা বলেন না। আসলে মুসলিমদের ব্যাপারে বরাবরই মুসলিম সুশীল সমাজ বা আমরা একরকম অন্ধ। এসব নিপীড়িত মুসলিম মানুষের কান্না তাদের কানে যায় না। কাশ্মীর, লিবিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, আইএস বা ফিলিস্তিনিদের সেই পুরোনো দুর্দশা নিয়ে বিবৃতি দিয়ে সংহতি প্রকাশে তারা ব্যস্ত হয় মাঝে মাঝে।

সারকথা

বেইজিং চায় উইঘুর তাদের ধর্ম ও আদর্শ বদলে ফেলুক। কমিউনিস্ট ও সি চিনের অনুগত হোক। অন্যথায় হয়তো চীনের মদদে মিয়ানমার গণহত্যা চালিয়ে যেভাবে রোহিঙ্গাদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করেছে, তেমনি ১ কোটি ৩০ হাজার উইঘুরদের ভাগ্যে যে এমন পরিণতি হবে না, তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না।

সূত্র: জাতিসংঘের ইউএন ইউনিভার্সাল পিরিওডিক্যাল রিপোর্ট (UPR), International Media এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচের উইঘুরবিষয়ক প্রতিবেদন।

লেখক: উন্নয়ন গবেষক, কলামিস্ট