আর কত সাহেদ করিমের কথা জানতে হবে জাতিকে

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম
মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, এমনকি লোকজনের আলাপচারিতায় এখন একটাই খবর, ‘রিজেন্ট হাসপাতাল ও সাহেদ করিমের প্রতারণা’। খবর দেখে মানুষ প্রথমে সাহেদ করিমকে চিনতে পারেনি। কিন্তু ছবিতে নজর পড়লেই বিস্মিত হচ্ছে। কারণ, টিভি চ্যানেলগুলোর টক শোর অতি পরিচিত মুখ এই মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম।

টিভি স্ক্রলে সাহেদ করিমের নামের পাশে ‘রাজনৈতিক বিশ্লেষক’ লেখাটি দেখলে তাঁকে বোদ্ধা শ্রেণির মানুষ ভাবাই স্বাভাবিক। সাধারণ মানুষের কাছে টক শোর অতিথিরা দেশের সুশীল সমাজের বোদ্ধা হিসেবে সমাদৃত। ধারণা করা হয়, এঁরা দেশ, রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে চিন্তা করেন। এঁরা দেশও সমাজের মুখপাত্র। তা ছাড়া টক শোতে প্রজ্ঞাবান না হলে কি আমন্ত্রিত হতে পারেন!

আজ যখন সাহেদ করিমের আমলনামা প্রকাশ হচ্ছে, তখন মানুষের বিষম খাওয়ার জোগাড়। ভদ্রবেশী লেবাসধারী সাহেদ মানবসেবার নামে মানুষকে করেছেন বিপদগ্রস্ত।

কোভিড-১৯–কে পুঁজি করে সাহেদ করিম একদিকে ধনী হওয়ার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে গণমাধ্যমে বাহবা কুড়িয়ে মহান হওয়ার চেষ্টায় রত ছিলেন। কিন্তু বিধাতার নির্মম পরিহাস, সাহেদকে করোনাভাইরাস সামাজিকভাবে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছে। আইনের বিচারে তাঁর পরিণতি কী হবে, তা সময় বলে দেবে। তবে এ মহামারির সঙ্গে সাহেদ করিম ও রিজেন্ট হাসপাতালকে মানুষ মনে রাখবে, এটাই সত্যি।

বাংলাদেশের দুর্নীতির ইতিহাসে যোগ হলো আরেকটি উপমা। তবে এসব দুর্নীতিবাজের কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা মানুষের প্রতি ভালোবাসা নেই। এরা কেবল গিরগিটির মতো রং বদল করে সময় ও সুযোগ বুঝে। যার প্রমাণ সাহেদ করিম। তাঁর বিচরণ ছিল সর্বক্ষেত্রে। এখন প্রশ্ন হলো, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা, কর্মকর্তাদের কাছে তিনি কী করে গেলেন। কোন খুঁটির জোরে কোভিড-১৯ নিয়ে প্রতারণার খেলাতে মত্ত হয়েছেন। আর যাঁরা এ সুযোগ করে দিয়েছেন, তাঁর কি জানতেন না সাহেদ করিমের অতীত ইতিহাস?

সাহেদ করিমের আদ্যপান্ত বিশ্লেষণ করলে সাদাচোখে যে বিষয়টা উঠে আসে তা হলো, তাঁর গণমাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও সখ্য। বলা হয়ে থাকে, সাংবাদিকের চোখ হলো উৎসুক দৃষ্টি। সাহেদ করিম দীর্ঘ সময় ধরে গণমাধ্যমের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিচরণ করেছেন। অথচ তাঁকে নিয়ে কোনো প্রশ্ন জাগেনি। এ অন্ধত্ব সাংবাদিকতার জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তাই প্রশ্ন জাগে, টক শোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষকের তকমা লাগিয়ে প্রমোট করার উদ্দেশ্য কি শুধুই ব্যক্তিস্বার্থ, নাকি অন্য কিছু?

দেশের জাতীয় বা বিশেষ অনুষ্ঠানে সাহেদ করিমের মতো অনেকেই আজকাল আমন্ত্রণ পান। সেখানে সেলফি তুলে নিজের ক্ষমতা জাহির করেন নানাভাবে। এসব নব্য পদবিধারী বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমেই চলে যান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অনুষ্ঠানে। আবার জাতীয় অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেতে কত ধরনের তদবির চলে, তা অনেকেই জানেন। অসৎ উদ্দেশ্যের ব্যক্তিদের কাছে এ ধরনের অনুষ্ঠান হয় লোভনীয়। কারণ, ক্ষমতাসীন দল বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো সুযোগ নেই। পরিতাপের বিষয় হলো, দল বা সমাজের সম্মানিত ও অনেক যোগ্য ব্যক্তি সারা জীবনেও আমন্ত্রণ পান না গণভবন বা বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে।

সুচতুর মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম গণমাধ্যমের বর্তমান সময়ের ট্রেন্ডকে ব্যবহার করে রাতারাতি সেলিব্রিটি বনে যান টক শো করে। আর সেই সঙ্গে সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে সখ্য তাঁকে প্রতারণার সব রাস্তা উন্মোচন করে দিয়েছে। আজ অনেকেই সাহেদ করিমের বিষয়ে নীরব বা তাঁকে না চেনার ভান করছেন। কিন্তু তাঁদেরকেই ব্যবহার করে সাহেদ করিম ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেরিয়েছেন। একজন দুর্নীতিবাজ প্রতারক সাহেদের জন্ম এক দিনে হয় না। কিংবা তিনি একা অন্যায় করে পাহাড়সম বিত্তশালী হতে পারেন না। তাঁর দুর্নীতির পেছনে থাকে বিশেষ শক্তি। আর সে শক্তিকে বধ করতে না পারলে সাহেদ করিমের মতো মানুষের বিনাশ হবে না দেশ থেকে।

সাহেদ করিমের মতো লোকেরা এখন সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। কারণ, অর্থের লোভে যাঁরা এঁদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাঁরা কখনোই সরকার–সুহৃদ ব্যক্তি নন। তাই দীর্ঘদিন ক্ষমতাসীন থাকা আওয়ামী লীগকে সচেতন থাকাটা জরুরি। অপরাধীরা নানাভাবে দলে জায়গা করে নিয়েছে বা নিতে চাওয়াটা এখন স্বাভাবিক। আর তাদেরকে চিনে নিতে না পারলে তার ব্যর্থতার দায় নিতে হবে দলকেই।

কেবল দামি কাপড়ে মুজিব কোট পরিধান করলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণা করা যায় না। কোভিড–১৯ আওয়ামী লীগকে যে সত্য উন্মোচিত করে দিচ্ছে, তা অনেক শিক্ষণীয়। জাতিকে আরও দুর্নীতিবাজ, প্রতারক সাহেদ করিমকে চিনতে হবে আগামী দিনে। তা নাহলে সরকার ও জনগণের জন্য হবে কেবল হতাশাজনক।

লেখক: কলামিস্ট