বিসিএস নিয়ে কেন এত উন্মাদনা

বিসিএস—তিন অক্ষরের এই শব্দের সঙ্গে বহু স্বপ্নবাজ মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন-আশা-আকাঙ্ক্ষা জড়িয়ে থাকে। অনেকেই জীবনে সফল হওয়া বলতেই বোঝেন ‘বিসিএস ক্যাডার’ হওয়া। দিন দিন দেশে বিসিএস চাকরি চাহিদা, মানুষের বিসিএসের ওপর নির্ভরশীলতা অদ্ভুত হারেই বেড়ে চলছে। দেশের চাকরির বাজারে চারদিকে এখন শুধু বিসিএসের জয়ধ্বনি।

মনে প্রশ্ন জাগে, এত এত কর্মপরিবেশ থাকা সত্ত্বেও এ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম কেন শুধু বিসিএসের পেছনে দৌড়াচ্ছেন? সহজ উত্তর মান-সম্মান, যশ ও খ্যাতি।

কে না চান বস হতে? আমরা কমবেশি সবাই পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে চাই, বস হতে চাই। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিসিএসই একমাত্র চাকরি যেখানে বিশেষ মান-সম্মান, যশ-খ্যাতি পাওয়া যায়। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দিন দিন এ দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী, তরুণ প্রজন্ম বিসিএসের দিকে ঝুঁকছেন। আর এ চাহিদাই বিসিএসকে ‘সোনার হরিণে’ পরিণত করেছে।

বিসিএসের প্রতি আমাদের নির্ভরশীলতা এমন চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ৪০তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যা মালদ্বীপের জনসংখ্যাকেও অতিক্রম করেছে। দেশের বিশাল এক শিক্ষিত জনগোষ্ঠী উদ্যোক্তা বা আবিষ্কারক হওয়ার নেশা ছেড়ে আমলা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। এটা প্রকৃতপক্ষে দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়। হ্যাঁ, দেশের মেধাবীদের দেশ পরিচালনায় এগিয়ে আসা উচিত, কিন্তু তারও একটা সীমা রয়েছে। একটা দেশ তো শুধু আমলা বা আমলাতন্ত্র দিয়ে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না।

অনেক চড়াই–উতরাই পেরিয়ে গত ৩০ জুন ৩৮তম বিসিএসের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। ৩৮তম বিসিএস ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবে। কারণ, এ বিসিএসের পর থেকেই কোটা পদ্ধতির বিলুপ্তি ঘটছে। এ বিসিএসে বিভিন্ন ক্যাডার পদে ২ হাজার ২০৪ জনকে মনোনীত করা হয়েছে। সবাইকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

৩৮তম বিসিএসের ক্যাডার পদ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই তাঁদের পেশার সঙ্গে জড়িত ক্যাডার পদ ছেড়ে পররাষ্ট্র, প্রশাসন ও পুলিশ এবং অনেকেই সাধারণ ক্যাডার পদে পদায়নের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। ২২০৪ জনের মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন ২৫ জন। ২৫ জনের ৭ জন মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী, ১৩ জন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আবার ১৩ জনের ১০ জনই বুয়েটের শিক্ষার্থী।

এখন আমার সাদাসিধে প্রশ্ন, একজন মেডিকেল পড়ুয়া শিক্ষার্থী এত কষ্ট, এত পরিশ্রম করে, সময় ও অর্থ ব্যয় করে দীর্ঘ পাঁচ–ছয় বছর পড়াশোনা করে কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারে যোগদান না করে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ বা কর ক্যাডারে যোগদান করতে চান? তাঁদের পেছনে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে।

বাবা-মায়েরা একজন ছেলে বা মেয়েকে চোখভরা স্বপ্ন আর বুকভরা আশা নিয়ে মেডিকেলে ভর্তি করান, তাঁর ছেলে বা মেয়েটিকে ডাক্তার বানাবেন বলে। তা ছাড়া একজন ডাক্তার স্বাস্থ্য ক্যাডারে এলে সেটা আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতের জন্য যেমন কল্যাণকর, তেমনি দেশ ও জাতির গর্বের বিষয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধন নিয়েছেন। বর্তমানে সরাসরি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত এমন চিকিৎসকের সংখ্যা (সরকারি ও বেসরকারি) ৬০-৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৫-৩০ হাজার। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন।

সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সূত্র অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয় ১৫-১৮ লাখ টাকা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ১০ লাখ টাকার অধিক। এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের দিন দিন অন্য পেশায় চলে যাওয়া দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়।

এমনিতেই দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা ভয়াবহ। করোনা পরিস্থিতিতে আমরা তা চরমভাবে উপলব্ধি করতে পারছি। এমতাবস্থায় ডাক্তারদের ডাক্তারির মতো মহৎ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়া দেশের জন্য অশনিসংকেত।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এ দেশে ডাক্তাররা তো আর প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরত একজন ক্যাডারের মতো সমান সুযোগ-সুবিধা, যশ-খ্যাতি পান না। হ্যাঁ, এটা সত্য যে একজন প্রশাসন কর্মকর্তা যে গাড়ি, বাড়ি বা অন্যান্য সুযোগ–সুবিধা পান, একজন ডাক্তার কিন্তু তেমনটা পান না।

স্বাস্থ্য ক্যাডারের শুরুতে প্রথমে একজন ডাক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নেই কোনো গাড়ির সুবিধা, ভাড়ায় থাকতে হয় সরকারি কোয়ার্টারে। ব্যক্তিগত সহকারী ও আলাদা কোনো অফিস থাকে না। পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন হবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির, যা শেষ করতে লাগে ১৪-১৫ বছর।

অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির শুরুতে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, ডিসি অফিসের কর্মকর্তা, এসি ল্যান্ড হিসেবে যোগদানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে ধারাবাহিক পদোন্নতির সুযোগ, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক টাকাও পান তাঁরা। ব্যক্তিগত সহকারী, পাওয়া যাবে আলাদা অফিসও। আর ইউএনও হলে সরকারি বাংলো ও গাড়ির সুবিধা তো রয়েছেই। পদোন্নতি পেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হতে পারেন। রয়েছে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়ার সুযোগ, প্রেষণে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের সুযোগও রয়েছে।

এসব বৈষম্যের দেয়ালই হয়তো ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে যোগ দিতে বাধ্য করছে বা অন্যরা সহজেই প্রলুব্ধ হচ্ছেন।

ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীদেরও একই অবস্থা। বুয়েটে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকসে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থী বিসিএস দিয়ে এখন পররাষ্ট্র ক্যাডারে যোগ দেবেন। এত বছর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে এখন চাকরির পরিবেশের কোনো মেলবন্ধন নেই। সে যদি তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পেশায় থাকত, আমরা হয়তো পেতাম সেরা আইটি চিপ নির্মাতা, ভবিষ্যৎ মাইক্রোসফটের মতো প্রতিষ্ঠাননির্মাতা, বিশ্বের সেরা প্রযুক্তিবিদ বা সফল বিজ্ঞানী।

ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদদের তাঁদের নিজস্ব পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যোগদানের ফলে সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হচ্ছেন সেসব পদ থেকে। বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, দর্শনসহ ইত্যাদি সাধারণ বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরাই তো যোগ্যতাবলে পররাষ্ট্র, প্রশাসন, পুলিশ, কর, সাধারণ ক্যাডার পাওয়ার কথা। সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল বা কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীদের মতো আলাদা তেমন কোনো চাকরির বাজার নেই।

একজন মেডিকেল শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মেডিকেলে চাকরি, ডাক্তারি। একজন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন শিল্পকারখানায় চাকরি। একজন কৃষিবিদেরও চাকরির আলাদা খাত রয়েছে।

বাণিজ্য অনুষদে পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্যও রয়েছে আলাদা চাকরির পরিবেশ। তাঁদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন ব্যাংক ও বিমা সেক্টর। বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান।

অন্যদিকে কলা ও সামাজিক অনুষদের শিক্ষার্থীদের একমাত্র ভরসা এ বিসিএস। এই বিসিএসই তাঁদের একমাত্র স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু বিসিএসে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে এ সমন্বয়হীনতার কারণে অনেক স্বপ্ন রীতিমতো ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে।

যে ক্যাডারগুলো সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পাওয়ার কথা, সেসব ক্যাডারে আসছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার ও কৃষিবিদেরা। সাধারণ এসব বিষয় নিয়ে পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থীর তো আর ডাক্তার তথা স্বাস্থ্য ক্যাডার হওয়া সম্ভব নয়। ৩৮তম বিসিএসসহ সম্প্রতি কয়েকটি বিসিএস এর জ্বলন্ত উদাহরণ।

সাকিব (ছদ্মনাম) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে পড়াশোনা সম্পন্ন করে বিসিএস দিয়েছে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখে আসছে বিসিএস দিয়ে পুলিশ সুপার (এসপি) হবে। ৩৮তম বিসিএসে সাকিব ক্যাডার হয়েছে ঠিকই, তবে পুলিশ ক্যাডার নয়, হয়েছে শিক্ষা ক্যাডার। এত দিনের স্বপ্ন ভেঙে তছনছ! ওই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদেরা যদি তাঁদের নিজস্ব পেশার ক্যাডারে থাকতেন, সাকিবের দীর্ঘদিনের লালিত সেই স্বপ্ন হয়তো ভেঙে চুরমার হতো না।

আমার কোনোভাবেই বুঝে আসে না কৃষি ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা কেন কৃষিসচিব হবেন না? কেন স্বাস্থ্য ক্যাডারের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরিবর্তে ইংরেজি সাহিত্যের ছেলেটিকেই স্বাস্থ্যসচিব হতে হবে? কেন সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষক শিক্ষাসচিব হবেন না বা হতে পারবেন না?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এখন সময়ের দাবি। দিন শেষে দেশে দেখা যায়, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা ডিগ্রির সঙ্গে আমাদের চাকরি বা কর্মক্ষেত্রের কোনো মিল থাকে না। এ জন্য ডাক্তারি পড়ে একজন ডাক্তার না হয়ে যোগ দিচ্ছেন প্রশাসনে। ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে আজীবন পড়োশোনা করে যোগ দিচ্ছেন পুলিশে। এতে শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য সাধন ব্যর্থ হচ্ছে কি না?

শিক্ষাব্যবস্থাকে এখন ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। যে যে বিষয়ে পড়াশোনা করছেন তাঁর জন্য, তাঁর বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত সে রকম কর্মপরিবেশ তৈরি করতে হবে। পেশা অনুযায়ী সব পেশায় সমান সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য শিক্ষা খাতের সংস্কারের জন্য প্রচলিত নিয়মকানুন পরিবর্তনে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। বিসিএসের মতো তুমুল প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরি পরীক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রির ওপর সমন্বয় তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে ক্যাডার মনোনয়ন দিতে হবে, দূর করতে হবে আন্তক্যাডার বৈষম্য। তখন হয়তো বৈষম্যের দেয়াল ভাঙবে। শিক্ষার মহৎ উদ্দেশ্য সাধিত হবে।

* শিক্ষার্থী: ইংরেজি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

আরও পড়ুন