অমানবিকতা না থাকুক আর পৃথিবীতে

আমি তখন প্রাইমারিতে পড়ি। আমার সঙ্গে একটা মেয়ে পড়ত। ওর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী একটা বড় ভাই ছিল। আমাদের থেকে বেশি হলে তিন-চার বছর বড় হবে।

বোনটা স্কুলে পড়ায় প্রায়ই সে স্কুলে এসে বারান্দায় অথবা মাঠে বসে থাকত। একদিন দেখলাম মেয়েটা একা একা ক্লাসে বসে কাঁদছে। জিজ্ঞেস করায় জানতে পারলাম, তার ভাইকে আমাদেরই কোনো এক শিক্ষক (নাম প্রকাশ না করলাম) বেত দিয়ে খুব মেরেছে এবং স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই আমি ভুলে গেছি কিন্তু এই স্মৃতিটা কেন যেন কখনো ভুলতে পারিনি। ছেলেটা খুবই মিশুক ছিল। আমাকে দেখলেই হাসতে হাসতে কাছে আসত। আমার বাবা যখন স্কুল থেকে আমাকে আনতে যেতেন, তখন ছেলেটাকে স্কুলে দেখলে ওর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করতেন। আমাকেও বলতেন, কখনো যেন এ রকম মানুষকে ভয় না পাই অথবা খারাপ ব্যবহার না করি।

ছেলেটাকে আমি নিজে কখনো কোনো বাজে ব্যবহার বা মার খাওয়ার মতো কোনো কাজ করতে দেখিনি। তবু তাকে কেন মার খেতে হয়েছিল, এটা ভাবলে একটাই কারণ আমার সামনে আসে। সেটা হচ্ছে, সে আর দশটা মানুষের মতো না। তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ অন্য মানুষের থেকে অনেক কম।

বর্তমানে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগে অধ্যয়নরত। আমাদের বিভাগের কাজই আসলে এ ধরনের মানুষকে সাহায্য করা। বিভাগের কল্যাণে এ রকম অনেক মানুষকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সুযোগ হয়েছে তাদের পরিবারের দুঃখ–দুর্দশাগুলো জানার।

অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁদের শিশুটিকে অন্যরা তাঁদের বাচ্চাদের সঙ্গে মিশতে দিতে চান না। অনেকের ধারণা, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুটির সঙ্গে মিশলে তাঁদের বাচ্চার সমস্যা হতে পারে। অনেকে এসব বাচ্চাদের নিয়ে ঠাট্টা করেন। তাদের দিয়ে অহেতুক নানা কাজ করায়, যেগুলো দেখে অন্যরা ব্যঙ্গ করতে পারে বা মজা নিতে পারে। অনেকে আবার এদের পাগল হিসেবে আখ্যা দেন।

একটা বিশেষ শিশুকে নিয়ে তার পরিবারের যে কতটা কষ্ট ভোগ করতে হয়, তা আসলে আমরা চিন্তাও করতে পারব না। তাদের ঠেলে দেওয়া হয় বৈষম্যের দিকে। অহেতুক নির্যাতন, আশপাশের মানুষের অমানবিক ব্যবহারই তাদের এগোতে দেয় না।

অথচ আমাদের একটু মানবিক আচরণই কিন্তু বদলে দিতে পারে এসব শিশুর জীবন। তাদের প্রতি সমাজের যে বিরূপ আচরণ, এটা কমিয়ে আনতে পারলেই তাদের বিকাশের সুযোগ অনেক বেড়ে যাবে। তাদের পরিবারের হীনম্মন্যতাও কমে যাবে অনেকটা।

আসুন আমরা একটু মানবিক হই। এসব শিশুদের বোঝা না ভেবে, তাদের সাহায্য করি জীবনে ভালো থাকতে। এগিয়ে যেতে।