মায়েরা কখনো কাঁদে না...

আমার এখন অফুরন্ত সময়, অফুরন্ত সময় মানুষকে অতীত নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে। সকালবেলা ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আজ আর ঘুম আসছে না, আজ আমি একজন মা, অনেক দায়িত্ব। একটু পরে সবার জন্য নাশতা বানাতে হবে। ব্যস্ত জীবনে নিজের বলে কিছু নেই। এক কাপ চা নিজের জন্য বানিয়ে বারান্দায় বসলাম, ভোরের আকাশটা কত সুন্দর।

আজ প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে দেশে যাই না, আমাদের বাংলা ভাষাটা যে কত সুন্দর, তা একটা শব্দেই বুঝিয়ে দেয় ‘মা’। ছোট একটা শব্দ কিন্তু কত গল্প, কত মায়া জড়ানো। কিছু মানুষ থাকে, যাদের কখনো ভালোবাসি বলা হয়নি, কিছু মানুষ থাকে, যাদের কখনো সরি বলা হয়নি। তাদের মধ্যে একজন হচ্ছে আমার মা।

তাহমিনা দেখতে সুন্দর, ছিমছাম সব সময় নিজেকে গুছিয়ে পরিপাটি করে চলতে পছন্দ করত। এক কিলোমিটার হেঁটে যখন বাড়ির কাছের কলেজে যেত, সব সময় মাথা নিচু করে হাঁটত। পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল। কলেজ শেষে তাহমিনা বাবার সহায়তায় চারুকলায় ভর্তি হলো, তার মায়ের সে কী অভিমান চারুকলায় মেয়েরা পড়া মানে বিশাল অপরাধ, সময়টা ছিল ১৯৮৩, কয়জন মেয়েই বা পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারত। তারপরও মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় এল তাহমিনা। টিউশনি, রংতুলি আর পড়াশোনা করে ভালোই যাচ্ছিল তাহমিনার সময়। হঠাৎ করে বাবা মারা যাওয়ায় পুরো আকাশটা ভেঙে পড়ে। কিছুদিন যেতে না যেতেই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দিতে বাধ্য হয়, বিয়ে হয়ে যায় হুট করেই, একফোঁটাও কাঁদেনি সেদিন তাহমিনা, মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে।

ভদ্রলোক একটি বেসরকারি অফিসে কাজ করে, ভালোই যাচ্ছিল দিন, ভদ্রলোককে চিনতে চিনতেই তাহমিনার অবিকল অস্তিত্ব পৃথিবীতে আসে, আর সে হচ্ছি আমি। আমাকে নিয়ে অনেক কষ্টে পড়াশোনাটা শেষ করেছিল। আমার বাবা চাইত না মা ছবি আঁকুক, তাই মনের ক্যানভাসটা মনেই যত্ন করে রেখে রংপেনসিল, তুলিগুলো সব আলমারিতে তুলে রেখেছিল। মায়ের সেদিন প্রথম চাকরির ভাইভা, আমি তখন ছয় মাসের কোলের শিশু, আমাকে বাবার কোলে দিয়ে মা ভাইভা দিতে যখন ডুকল, আমি সজোরে কান্না শুরু করলাম, বাবা আমাকে নিয়ে ভাইভা রুমের জানালা দিয়ে বারবার মাকে আমাকে দেখিয়ে বের হয়ে আসতে ইশারা করছিল। সেদিনের মায়ের সঙ্গে জিদ করে চারুকলায় পড়তে আসা তাহমিনা আজ নিজেই যখন মা হলো, সে নিজেই আজ আমার কান্নার কাছে হেরে গিয়েছিল। বাবা আসার সময় মাকে বলেছিল এই জন্যই বলেছিলাম চাকরির দরকার নেই, সেদিনও তাহমিনা কাঁদেনি, মেনে নিয়েছে। আর কখনো চাকরি করতে চায়নি মা।

আমাকে আর সংসার নিয়ে খুব ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছিল। আমি বিরক্ত করি, তা–ও মা হাসে, আমি খেতে চাই না, মা চিন্তায় পড়ে যায়। যেদিন আমি প্রথম ‘আ উ’ বলি মা খুশিতে মসজিদে ৫০ টাকা দিয়েছিল। ওই সময়ে ৫০ টাকা অনেক টাকা, বাবা রাগ করত আমাকে নিয়ে মায়ের এসব পাগলামি দেখে, তা–ও মা হাসতে। আমি যখন প্রথম হাঁটতে শিখি, তখন মা ফকির বাসায় ডেকে এনে দুপুরে ভাত খাইয়েছিল। আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছিল মা, তার মনের সমস্ত রং আমিই ছিলাম, সে ভুলে গিয়েছিল আলমারিতে তুলে রাখা রংপেনসিলের কথা।

আমার নানুমণি যেদিন মারা গেলেন, তার দুই দিনের মধ্যেই মা ঢাকায় চলে এসেছিল। কারণ, কিছুদিন পর আমার এসএসসি পরীক্ষা ছিল। আমি কলেজ থেকে যখন বিকেলে ফিরতাম, মাকে বলতাম তুমি ছাদে যাও না কেন, একটু হাঁটাহাঁটি করলেও তো ভালো লাগে, সে আমাকে সেদিন উত্তর দিয়েছিল, সারা দিন তোকে দেখি না, তোকে দেখলেই আমার ভালো লাগে। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে বাসায় আসতাম, সে আমার জন্য বসে থাকত আমার কাছ থেকে আমার বন্ধুদের গল্প শোনার জন্য। তখন মাকে জিজ্ঞেস করতাম, তোমার কোনো বন্ধু নেই, সে আমাকে বলেছিল, আমিই নাকি তার বন্ধু।

মা ছিল আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক, আমি সুন্দর করে পরিপাটি হয়ে বের না হলেই রাগ করত, আমাকে যেন সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে, সেই তার চিন্তা। কিন্তু যখন তাকে একটু সাজতে বলতাম, হেসে উড়িয়ে দিত। যেদিন প্রথম একটা ছেলেকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছিলাম, মায়ের কাঁধেই মাথা রেখে কেঁদেছিলাম। আমার কান্না দেখে সে যখন হেসেছিল, আমি বিজ্ঞের মতন বলেছিলাম, তুমি আসলে আমাকে বুঝই না। মাকে কখনো বাবার সঙ্গেও এত গল্প করতে দেখিনি, তার সব গল্প আমার সঙ্গে। নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম, বাবা রাজি, ছেলে সব দিক দিয়ে ঠিক আছে, কিন্তু মা বাদ সাধল। তার একটাই কথা, আমাকে বিদেশে পাঠাবে না, আমাকে সে চোখের আড়াল করবে না। দুই দিন না খেয়ে জিদ ধরেও যখন মাকে রাজি করাতে পারিনি, অনেক ঝগড়া করেছিলাম সেদিন, রাগে মাকে বলে ফেলেছিলাম তুমি খুব স্বার্থপর, তুমি চাও না আমি ভালো থাকি। এরপর মা আর একটা কথাও বলেনি আমার বিয়ে নিয়ে। যখন আমি কবুল বলছিলাম, ওই ভিড়ের মধ্যে আমি মাকে খুঁজছিলাম, পাইনি; পরে শুনেছি, সে ওখানে ছিলই না, ছাদে চলে গিয়েছিল।

বিয়ের চার মাস পরেই আমি বরের সঙ্গে জার্মানি চলে আসি। যেদিন চলে আসব এয়ারপোর্টে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলাম, কিন্তু সেদিনও সে কাঁদেনি। আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি জার্মানিতে আসার পর মা আমাকে এক দিনও বলেনি তোকে দেখতে ইচ্ছা করছে। কথা হয়েছে, সব সময় খোঁজ নিয়েছে, খেয়েছি কি না জিজ্ঞেস করেছে। আর আমি আমার তথাকথিত দায়িত্ব পালন করেছি, টাকা পাঠিয়েছি। ডাক্তারের রেকমেন্ডে বিদেশি ওষুধ পাঠিয়েছি। সব সময় দেখাশোনার জন্য লোক রেখে দিয়েছিলাম। বাবা মাঝেমধ্যে বলত, মা ইদানীং খুব চুপচাপ হয়ে গেছে, ঘুমায় না, নামাজ পড়ে আর রাত হলে ছাদে গিয়ে বসে আকাশ দেখত। আমার যখন প্রথম সন্তান হলো, সারা রাত বাবা স্কাইপে ছিল, আমার বরের সঙ্গে কথা বলেছে, কিন্তু মা সারা রাত জায়নামাজে ছিল একবারও কথা বলেনি।

একদিন রাতে মায়ের বুকে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়, বাবা দেরি না করে ইবনে সিনায় নিয়ে গেল। সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম প্রথম কেন মা আমাকে দেশের বাইরে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। সেদিন নিজেকে সবচেয়ে বেশি অপরাধী মনে হয়েছে। স্কাইপে বাবা আইসিইউতে অচেতন অবস্থায় থাকা আমার মায়ের মুখটা একটু দেখাল। সে রাতের কথা আমি আজও ভুলতে পারিনি। যে সময়ে মায়ের পাশে থাকা আমার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল, সে সময়ে তাকে একা রেখে চলে এসেছি আমি। যে মা আমার জন্যই নিজের কথা কখনো ভাবেনি, যে মা নিজের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে, আমার স্বপ্নে বিভোর ছিল, যে মা আমার মধ্যেই নিজের সব সুখ খুঁজে নিত, তাকে আমি আর দেখতে পাইনি সেই রাতের পর। স্বার্থপরের মতো নিজের ভালোবাসার সঙ্গে, নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিয়েছি, বিনিময়ে তাকেই স্বার্থপর বলে এসেছি। আমার মতন সে–ও যদি স্বার্থপর হতে পারত, তাহলে তার নিজের জীবন বলে কিছু একটা থাকত। রংপেনসিলগুলো আলমারিতে তুলে রেখে স্বপ্নগুলোকে তালা দিয়ে আটকে রাখত না। মাকে আমি কখনো কাঁদতে দেখিনি, দেখেছি আমাকে ভালো থাকতে দেখার স্বপ্ন। মায়েরা কাঁদে না, সারা জীবন বিসর্জন দিয়ে অভিমান করে চলে যায়।