গৌরবের ২৩ বছরে গণ বিশ্ববিদ্যালয়

১৪ জুলাই। ১৯৯৮ সালের এই দিনেই গ্রামের মানুষের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় গণ বিশ্ববিদ্যালয় (গবি)। নিম্নমধ্যবিত্তের বিদ্যাপীঠটি আজ বাংলাদেশের অন্যতম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মঙ্গলবার (১৪ জুলাই) এ বিশ্ববিদ্যালয় ২৩তম বর্ষে পদার্পণ করেছে।

সাভার স্মৃতিসৌধের কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা গণ বিশ্ববিদ্যালয় এক ব্যতিক্রমী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক জাতি গঠন, নিম্ন আয়ের মানুষের উন্নতি ও নারীসমাজকে যথাযথ মূল্যায়নের লক্ষ্যে মনোরম পরিবেশে শিক্ষাক্রম শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য ২৩ বছর বেশি সময় নয়। কিন্তু এই অল্প সময়েই বেশ সুনাম ও খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে সাভারের বিদ্যাপীঠটি।

করোনাকালীন সময়ে ড. বিজন কুমার শীল করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট প্রস্তুত করেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞান বিভাগের পরীক্ষাগারে। মানুষের সঙ্গে কথা বলা, বিভিন্ন জটিল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, ভার্চ্যুয়াল কাজে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন সুবিধা–সংবলিত রোবট তৈরি করেছে এখানকার কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের শিক্ষার্থীরা। গবেষণা ও সৃজনশীল কাজের দক্ষতায় এগিয়ে নব্বই দশকের এ বিদ্যাপীঠের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

শরীরচর্চা ও খেলাধুলায় সেরা বিশ্ববিদ্যালয় গবি। প্রসঙ্গত, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আয়োজন করা হয় ‘বঙ্গবন্ধু আন্তবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্প ২০১৯’। সারা দেশ থেকে ৬৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। এতে ছেলে ও মেয়েদের চারটি ইভেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছে গণ বিশ্ববিদ্যালয়। বাংলাদেশ জাতীয় হ্যান্ডবল দলের খেলোয়াড় ছন্দা রানী সরকার ও জাতীয় নারী ফুটবল দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন এখানকার সমাজবিজ্ঞান ও সমাজকর্ম বিভাগের ছাত্রী।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম সাংবাদিক সমিতি প্রতিষ্ঠা হয়েছে এখানে। শুধু তা–ই নয়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একমাত্র এ বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে নির্বাচিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রথম নিরিবিলি পরিবেশে নিজস্ব ক্যাম্পাস নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে।

এ ক্যাম্পাসে ঢুকতে চোখে পড়বে সুবিশাল দুটি খেলার মাঠ। পাশে রয়েছে ছয়তলা ‘ঊ’ আকৃতির একাডেমিক ভবন ও দুটি প্রশাসনিক ভবন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদলে বানানো হয়েছে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক কার্যালয়, ছাত্র সংসদ কার্যালয়, সাংবাদিক সমিতি কার্যালয়, ডিবেটিং সোসাইটি কার্যালয়, ভর্তি অফিস, ব্যাংক, তেলের পাম্প ইত্যাদি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য রয়েছে বিশাল গ্রন্থাগার। পড়াশোনা ও খেলাধুলার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের শরীর ও মন সতেজ রাখতে নির্মাণ করেছে দৃষ্টিনন্দন ব্যায়ামাগার।

এখানে রয়েছে শিশুদের জন্য আলাদা করিডর, বিশ্রামাগার ও খেলাধুলার কক্ষ। এ ক্যাম্পাসটি দেখে যে কারও মন ভরে উঠবে। শরতে পার্কিং জোনের কোল ঘেঁষে কাশফুলের মিছিল মনে এনে দেয় প্রশান্তি। বর্ষায় বাদামতলার আড্ডা আর সন্ধ্যা পর্যন্ত খুনসুটিতে মেতে থাকে গোটা ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণ।

পিঠাপুলির দোকান বছরজুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রিয় ঠিকানা। সবুজ ছাউনি নিচে ক্যানটিনে খানাপিনা, আড্ডা ও হৈহুল্লোড় লেগেই থাকে দিনভর। ট্রান্সপোর্ট চত্বর যেন উৎসব উদযাপনের প্রাণকেন্দ্র। হিটলার চত্বরের ঝালমুড়ি, ভেলপুরী ও টক–ঝাল–মিষ্টির কাঁচা কলার ভর্তা খেতে খেতে আপনি হয়তো ভুলেই যাবেন এটি একটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। টেনিস কোর্ট, বাস্কেটবল ও জলাধার ঘিরে রাত পর্যন্ত থাকে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা। সব মিলিয়ে এ যেন স্বপ্নের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়।

এটি একমাত্র প্রতিষ্ঠান, যেটি নারী অধিকার ও সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণে বিশ্বাসী। আর তাই প্রথম কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের কাজের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় লিঙ্গের চারজন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের দায়িত্বে রয়েছে।

একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার সুযোগ রয়েছে এ ক্যাম্পাসে। এ বিদ্যাপীঠে নানা গ্রামীণ উৎসবের আয়োজন করা হয়। যেমন পিঠা উৎসব, বৈশাখী উৎসব, ফানুস উৎসব, পূজা, প্রদীপ প্রজ্বালন, ঘুড়ি ওড়ানো, আলোকচিত্র প্রদর্শনী। বছরজুড়ে থাকে এমন নানা আয়োজন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে শিক্ষার্থী পরিচালিত ১৮টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।

এটি একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে প্রশাসনিক সব কার্যক্রম মাতৃভাষা বাংলায় পরিচালনা করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৪টি অনুষদে ১৬টি বিভাগে শিক্ষাক্রম চলছে। প্রায় ৪ হাজার শিক্ষার্থী, ১৭৬ শিক্ষক, ৪১ কর্মকর্তা ও ৮৪ জন কর্মচারীর পদচারণে মুখর থাকে ৩২ একরের ক্যাম্পাস।

গবি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মীর মুর্ত্তজা আলী বাবু বলেন, পথচলার ২৩ বছর গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রমান্বয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ অগ্রযাত্রায় ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী সবারই অবদান রয়েছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সব বাধা অতিক্রম করে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে যাবে—প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনে এমন প্রত্যাশা করি।

২৩তম বর্ষে পদার্পণে বিশ্ববিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. দেলওয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের অনেক শিক্ষার্থী দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে কর্মরত আছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও তারা জায়গা করে নিয়েছে। প্রত্যাশা থাকবে, আগামী দিনে প্রতিষ্ঠানটি আরও উন্নতির দিকে ধাবিত হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩তম জন্মদিনে প্রাণঢালা শুভকামনা জানাচ্ছি।’


*শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়