ফুলবাড়িয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ যানে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে শিশুদের

পাঁচ বছরের শিশুসন্তানের আবদার রাখতে এভাবেই ভ্যানচালক বাবা চালকের আসনে বসিয়ে দিলেন তাঁর সন্তানকে। ছবিটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: লেখক
পাঁচ বছরের শিশুসন্তানের আবদার রাখতে এভাবেই ভ্যানচালক বাবা চালকের আসনে বসিয়ে দিলেন তাঁর সন্তানকে। ছবিটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: লেখক

বড়খিলা গ্রামের নাছির উদ্দিনের ১০ বছরের ছেলে শাহাদাত বাবার অজান্তেই ভরদুপুরে বেটারিচালিত ভ্যান নিয়ে রাস্তায় নেমে গেছে দিব্যি। এমন সময় কম ভাড়া দেওয়া লাগবে বলে স্থানীয় কাঠ ব্যবসায়ী সাবু মিয়া, তাঁর ফার্নিচারের দোকান থেকে আসবাব বোঝাই করে কেশরগঞ্জ বাজারের দিকে যেতে বললেন শিশুটিকে। শিশু শাকিল বেশি পরিমাণ মালবোঝাই করার কারণে ভ্যানগাড়ি চালিয়ে নিতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটারের পথ পাড়ি দিলে ২০ টাকা পাবে সে।

সামান্য আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি তুলে দেওয়া হচ্ছে কোমলমতি শিশুদের হাতে। হতদরিদ্র পরিবারগুলোর অভিভাবকেরা অনেকটা অসচেতনতায় এমনটা করছেন। এতে সড়কে নানা দুর্ঘটনার পাশাপাশি পড়াশোনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে স্কুলগামী শিশুরা।


উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজারে অহরহ খোঁজ মেলে এমন শিশুর। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এভাবে চলতে থাকলে কয়েক বছরের মধ্যে শিশুশ্রম বাড়ার পাশাপাশি স্কুল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে অসংখ্য শিশু।

স্থানীয় ভ্যানচালকদের কাছ থেকে জানা যায়, প্রত্যেক শিশু ভ্যানচালক প্রথমে নিজের বাবার ভ্যানগাড়িতে খেলার ছলে হাতেখড়ি হয় তাদের। এদিকে করোনাকালীন সময়ে স্কুল বন্ধ থাকায় ভ্যানচালক পিতা সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি করলে কিংবা দুপুরবেলা খেতে এলে সেই সুযোগটিকেই কাজে লাগায় শিশুরা। ছোটখাটো ভাড়া পেলে কয়েক ঘণ্টায় ৫০ থেকে ১০০ টাকা রোজগার করতে পারে। শিশুটি যখন বাড়ি ফিরে বাবার হাতে কিছু টাকা ধরিয়ে দেয়, বাবাও খুশি হন। এভাবেই অবসর পেলেই বাবার ভ্যান নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে শিশুরা, যা পরবর্তী সময়ে পড়াশোনাকে ছুটি দিয়ে ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়িতেই উপার্জনের অবলম্বন হিসেবে বেছে নেয় তারা। এ ছাড়া এমন অনেক হতদরিদ্র পরিবার আছে, যেখানে নিজ ইচ্ছায় ৭ থেকে ১০ বছরের শিশুরা সংসারের খরচ চালাতে ভাড়ায় ভ্যানগাড়ি চালিয়ে সংসারের জন্য রোজগার করে।

উপজেলার রাঙামাটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘করোনার মহামারিকালে স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুরা এখন বাড়িতে। আমার প্রতিষ্ঠানটি পাহাড়ি এলাকায় হওয়ায় বেশির ভাগ শিশুই হতদরিদ্র পরিবার থেকে এসেছে। রাস্তাঘাটে আমার স্কুলের অনেক শিক্ষার্থীকেই দেখি ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়িতে যাত্রী কিংবা মালামাল বহন করছে। অভিবাভকেরা যদি সচেতন না হন, তবে কিছুদিন পর এই শিক্ষার্থীরা আর স্কুলে আসবে না। আমার মনে হয়, এই শিশুশ্রম এবং শিশুদের এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের বিরুদ্ধে প্রশাসনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।’

শিশুরা ভ্যান চালাচ্ছে। ছবিটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: লেখক
শিশুরা ভ্যান চালাচ্ছে। ছবিটি ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রাম থেকে তোলা। ছবি: লেখক

সরেজমিনে উপজেলার রাঙামাটি, কেশরগঞ্জ, আছিম, শিবগঞ্জ, ভবানীপুর, এনায়েতপুর, দেওখলা, কুশমাইলসহ বিভিন্ন ছোট–বড় হাটবাজার ঘুরে দেখা যায় রাস্তায় অহরহ ৭ থেকে ১০ বছের কিংবা কখনো এর কম বয়সের শিশুরা ব্যাটারিচালিত ভ্যানগাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে, বেশি গতিতে গাড়ি চালিয়ে ওভারটেক করতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হতে দেখা গেছে শিশু চালকসহ যাত্রীদের। অনেক অভিভাবক আজকাল নিজেই ভ্যানগাড়ির চাবি তুলে দিচ্ছেন তাঁর সন্তানের হাতে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউওনও) আশরাফুল সিদ্দিকী বলেন, ‘বিষয়টি খুবই দুঃখজনক, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে এবং পারিবারিক অসচ্ছলতায় অনেক শিশুকেই আজকাল এ ধরনের ব্যাটারিচালিত যানবাহনগুলো চালাতে দেখা যাচ্ছে। আমরা অনেক চেষ্টা করেও এ সমস্যা রোধ করতে পারছি না। তবুও আমরা আমাদের নিয়মিত গণসচেতনতা এবং শিশুদের দিয়ে এমন কাজের বিরুদ্ধে অভিযানসহ সচেতনতা অব্যাহত রেখেছি।’