মধ্যবিত্তের কাঠামো ভঙ্গুর, জীবন-সংসার উঠছে পিকআপে

বিশ্বের প্রায় ৮০০ কোটি মানুষ তাদের জীবদ্দশায় কোনো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে এত পাহাড়সম সমস্যার মুখোমুখি হয়নি। বহুমাত্রিকভাবে নাজেহাল হওয়ার অভিজ্ঞতা এমন অসহায় চোখে দেখেনি। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে লাখ লাখ, মরছেও দুর্বার গতিতে। এই যে করোনায় আক্রান্ত আর মরা, এটা ছাড়াও বিশ্বের মানুষ কোনো দিন আগে কল্পনাতেও ভাবেনি যে এটি শুধু মরে যাওয়াতেই শেষ পরিণতি হবে না, এর আছে অনেক ক্ষতের দিক। এই বহুমাত্রার অভিঘাত সব দেশেই হচ্ছে। আমাদের দেশের মানুষের জীবন, ব্যবসা, চাকরিসহ আয়রোজগার সব সেক্টর ঝিমিয়ে গেছে। কোনো কোনোটা বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হওয়ার অপেক্ষায় আছে অনেক সেক্টরের কাজকর্ম।

এককথায় জীবন–জীবিকার সীমাহীন সংকট বাংলাদেশের মানুষ অতিক্রম করছে।

স্থবির ব্যবসা–বাণিজ্য
রাজধানীর নিউমার্কেটের তৈরি পোশাকের দোকান ইজির বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ঈদের আর কিছুদিন বাকি থাকলেও ক্রেতা আসছেন না। প্রায় ৭০ শতাংশ বিক্রি কমে গেছে। যে পরিমাণ বিক্রি হচ্ছে, তাতে দোকান ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, স্টাফদের বেতন হবে না। বিক্রি বাড়াতে নতুন-পুরোনো অনেক পোশাকের মূল্যে ছাড় দেওয়া হলেও ক্রেতা পাওয়া যাচ্ছে না। বিক্রি কমে যাওয়ায় গত মাসে অর্ধেক বেতন দেওয়া হয়েছে, এ মাসে এখনো বেতন দেওয়া হয়নি। কবে পাবেন, তা–ও অনিশ্চিত বলে জানান তিনি।

করোনার সংক্রমণের ঝুঁকিতে শপিং সেন্টারে চলছে সুনসান অবস্থা। বড়, ছোট ও মাঝারি আকারের রেডিমেড দোকানের বিভিন্ন পণ্যে ডিসকাউন্টের (ছাড়) প্ল্যাকার্ড ঝুলিয়ে রাখলেও ক্রেতা মিলছে না। ক্রেতাশূন্য হওয়ায় বিক্রেতারা প্রতিদিন দোকান খুলে অলস সময় পার করছেন।

রাজধানীর বিভিন্ন রেডিমেড মার্কেট ও বিপণিবিতান সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র ভবিষ্যতের ব্যবসায়ীদের জন্য দীর্ঘ মেয়াদের ভয়ংকর করোনাসৃষ্ট অভিঘাত হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকেরা।

ঈদুল আজহার আগেই কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকে রাজধানীর মানুষ। ঈদ চলে এলে কোরবানির গরু নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়। এবার করোনার কারণে সেই চিত্র পাল্টে গেছে। ঈদের এক মাস আগে রাজধানীর মার্কেটে ক্রেতাসমাগম হচ্ছে না। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত শপিং মল খোলা রাখতে সরকার অনুমতি দিলেও জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি বিবেচনা করে অনেক বড় মার্কেটই বন্ধ রয়েছে।

চীন থেকে ফটোকপিসহ এর কালি ও যন্ত্রাংশ আমদানি করে মালিবাগের সোফিয়া অফিস ইকুইপমেন্ট। এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সালাউদ্দিন বলেন, অনেক ক্রেতা করোনার কারণে লোকসানে থাকায় মাল নিচ্ছেন না। তাঁদের ফটোকপির দোকান বন্ধ। আবার দু–একজন নিলেও ঠিকমতো দাম পরিশোধ করতে পারছেন না। বাকিতে নিচ্ছেন। এভাবে চলতে থাকলে অন্য ব্যবসা করতে হবে।

পড়াশোনা শেষে চাকরির পেছনে না ছুটে হামিদুর রহমান রাজধানীর মিরপুর সেনপাড়া পর্বতায় একটি ফলের দোকান দেন। তাঁর দোকানের বেশির ভাগ ক্রেতা আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কিছু কোচিং সেন্টারের ছাত্র-ছাত্রী। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। এতে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে হামিদুরের দোকান। বিক্রি ৩০ ভাগে নেমে এসেছে। খরচ কুলাতে না পেরে দোকান ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। এখন রাজশাহী থেকে আম এনে অনলাইনে বিক্রি করে টিকে থাকার লড়াই করছেন। আমের মৌসুম প্রায় শেষ। দুশ্চিন্তায় কপালে ওপর ভাঁজ পড়ে আমের পর কী করবেন, আর কী ব্যবসা করবেন। পুঁজি শেষ হয়ে গেছে তাঁর, সঙ্গে কপালটাও পুড়েছে এমএ পাস করা হামিদুরের। আয় না থাকলে সাতক্ষীরার গ্রামের বাড়িতে থাকা বুড়ো মা–বাবা ও আইএ পড়া ছোট বোনের খরচ পাঠাবেন কী করে!

তাঁর মতো অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বাধ্য হয়ে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক সময়ের মতো ব্যবসা করতে পারছেন না তাঁরা। আয়রোজগার কমে যাওয়ায় নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন। আর এ পরিস্থিতি শুধু রাজধানীতে নয়, করোনার কারণে সারা দেশের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পড়েছেন বিপাকে।

গাইবান্ধার চা-সিগারেটবিক্রেতা আলিম আগে ঢাকা থেকে রেডিমেড পোশাক এনে সাঘাটা থানা বাজারের দোকানে সাপ্লাই দিতেন। কিন্তু করোনার কারণে আগের মতো ঢাকায় গিয়ে মাল আনতে না পাড়ায় বিক্রি কমে গেছে, যা দিয়ে চলে না। পেশার বদল ঘটিয়ে বাধ্য হয়েই চা-সিগারেট বিক্রি করছেন।

সাভারের একটি জুতার কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহ করতেন জামালপুরের জুয়েল আকন্দ। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে কারখানা লোকসানে পড়ে বন্ধ হয়ে যায়। জুয়েলের কাছ থেকে মাল নেওয়া বন্ধ করে দেন তাঁরা। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে জামালপুরের নিজের গ্রাম রশিদপুরে ফিরে গেছেন তিনি। এখন অটোরিকশা চালান। এই চিত্র পুরো অবস্থার যৎসামান্য মাত্র।
শুধু যে অল্প আয়ের ব্যবসায়ীরা ভালো নেই তা নয়, সঙ্গে বড় ব্যবসায়ীরাও বিপদে হাবুডুবু খাচ্ছেন। তাঁদেরও অনেকে পুরোনো ব্যবসার পাশাপাশি নতুন কিছু করার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ পুরোনো ব্যবসা বদলেই ফেলেছেন।
বাংলাদেশ রপ্তানিকারক সমিতির সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, করোনার কারণে অনেক কোম্পানি পুরোনো অর্ডার বাতিল করে দিয়েছে। নতুন অর্ডার নেই বললেই চলে। নতুন মালও আসেনি। আগের মজুত দিয়ে কারখানা চলছে। আগস্ট মাসের মধ্যে মাল না পৌঁছালে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতি হবে। এভাবে চলতে থাকলে অন্য কোনো ব্যবসার কথা ভাবতে হবে ব্যবসায়ীদের।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম মনে করেন, করোনার কারণে অনেকের আয়রোজগার কমেছে। অনেকের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব মানুষ কষ্টে আছে। অনেকে বেঁচে থাকার তাগিদে নতুন কাজ করার চেষ্টা করছে।

বাসাবাড়ির অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের চিত্র
গৃহকর্মীদের দিয়ে কাজ না করাতে পেরে কষ্টে রয়েছেন গৃহকর্ত্রীরা। মোহাম্মদপুর এলাকার এক কলেজশিক্ষিকা জানান, লকডাউনের শুরু থেকেই ঢাকার বাইরে নিজেদের জেলা মাগুরা শহরে রয়েছেন তিনি। নিজের ও সন্তানদের স্কুল বন্ধ থাকায় বাইরে রয়েছেন। ঢাকায় ফেরার ইচ্ছা হলেও ফিরছেন না। ঢাকায় ফিরে পুরো বাসার কাজ তাঁকে করতে হবে। আবার করোনার কারণে বাইরের কাউকে কাজে নেওয়ার ঝুঁকি নিতে চান না তিনি। একইভাবে মিলি নামের একজন আইনজীবী জানান, মার্চের ২০ তারিখেই গৃহকর্ত্রীকে পুরো মাসের বেতন দিয়ে বিদায় করেছেন। কোর্ট বন্ধ। বাসায় রয়েছেন তিনি। বাসার কাজ নিজেই করছেন। কাজ করতে গিয়ে পেশাগত বিভিন্ন কাজ যা বাসায় থেকে করা সম্ভব, তা ঠিকঠাকমতো হচ্ছে না জানান তিনি। এমনকি অবসর কাটানোর ফুরসতও খুব কম পাচ্ছেন। মহামারি করোনাকালে দুর্ভোগে রয়েছেন গৃহপরিচারিকারা। অনেকেরই কাজ নেই। খেয়ে না–খেয়ে দিনাতিপাত করছেন তাঁরা। চাকরি হারিয়ে ভিন্ন পেশায় চলে গেছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে সংকটে রয়েছেন গৃহকর্ত্রীরাও। গৃহপরিচারিকা রাখতে না পেরে অনেকেই বাসার পুরো কাজ নিজেরা করছেন। রাজধানীর ফকিরাপুলে নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছেন চার নারী। এর মধ্যে তিনজনই কাজে নতুন।

কাজের গতি কম হওয়ায় বারবার তাড়া দেওয়া হচ্ছিল তাঁদের। কথা বলে জানা গেছে, মধ্যবয়সী এই তিনজনের ছদ্মনাম রাহেলা, মমেনা, বিলকিস। কিছুদিন আগে কাজে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। রাহেলা কাজ করতেন নিকেতনে তিনটি বাসায়। থাকতেন নাবিস্কো এলাকায়। মার্চের ২৫ তারিখের পরই বাসার গৃহকর্ত্রীরা কাজে যেতে নিষেধ করে দেন। লকডাউনে স্বামী, সন্তান নিয়ে বাসায় ছিলেন। স্বামী রিকশাচালক। তাঁর তেমন রুজি নেই। মূল রাস্তায় দীর্ঘদিন রিকশা বন্ধ ছিল। এত দিন মূলত গৃহকর্ত্রীরাই সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের দেওয়া আর্থিক সহযোগিতায় চলেছেন। কিন্তু কাজ পাচ্ছেন না কোথাও। করোনাভাইরাসের কারণে বাইরের কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে বাসায় কাজ করতে দিচ্ছেন না গৃহকর্ত্রীরা। এটি একধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি হওয়ার কারণে দুর্ভোগে পড়েছেন রাহেলার মতো রাজধানী ঢাকার গৃহকর্মীরা। একই ঘটনা ঘটেছে মমেনা ও বিলকিসের ক্ষেত্রেও। লালমাটিয়ায় বিভিন্ন বাসায় কাজ করতেন তাঁরা।

কাজ হারিয়ে এই সাবেক গৃহকর্মী কূল–কিনারা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত পুরুষের জন্যও কঠিন সেই নির্মাণশ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন। এই কাজ সংশ্লিষ্ট এক শ্রমিক জানান, নির্মাণের অভিজ্ঞতা না থাকায় মানিয়ে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে তাঁদের। নির্মাণকাজ অনেক পরিশ্রমের। নির্মাণকাজ করে প্রতিদিন ৩৫০ টাকা করে পাচ্ছেন এই নারীরা।

মোহাম্মদপুরের জাকির হোসেন রোড থেকে প্রতিদিন ৬০ মিনিট হেঁটে বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির রাস্তা সংস্কারের কাজে যোগ দেন চামেলী বেগম। ৪০ বছর বয়সী এই নারী জানান, আগে তিনি ছাত্রদের মেসে রান্না করতেন। লকডাউনের কয়েক দিন আগেই সবাই মেস ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। তারপর থেকেই বেকার তিনি। এর মধ্যে বাসাবাড়িতে চাকরি খুঁজছেন। ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন বলে কেউ কাজে নেন না। চামেলীর, বাসা অনেক দূরে। রিকশায় আসা-যাওয়া করলে ভাড়া দিতেই সারা দিনের রুজির অর্ধেক চলে যাবে। তাই হেঁটেই বায়তুল আমান সোসাইটি পৌঁছে কাজে যোগ দেন। দুপুরে চিড়া আর গুড়, কখনো বাসি ভাত খান তিনি।
বিবর্ণ পোশাকশ্রমিকেরা

করোনার মধ্যে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৬৪ হাজার পোশাকশ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। প্রতিদিনই শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। প্রতিদিন শ্রমিকেরা কাজ হারাচ্ছেন। আগে যাঁদের চাকরির বয়স এক বছরের কম এবং বেতন কম, তাঁদের ছাঁটাই করা হয়েছে। এখন যাঁদের চাকরির বয়স বেশি, বেতন বেশি, তাঁদের ছাঁটাই করা হচ্ছে।

ছাঁটাই জুটমিলের শ্রমিক
জুলাই মাসের শুরুতে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দিয়েছে। গোল্ডেন হ্যান্ডশেকে সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে ২৫ হাজার শ্রমিক তাঁদের দীর্ঘদিনের চাকরি হারিয়েছেন।

গবেষণা জরিপের তথ্য
২৯ হাজার ৯০৯ জনের ওপর চালানো সাম্প্রতিক এক জরিপে বিআইডিএসের জরিপে অংশ নেওয়া ১৩ শতাংশ, যাঁরা ফরমাল সেক্টরে কাজ করতেন, তাঁরা চাকরি হারিয়েছেন। যাঁদের আয় ১১ হাজার টাকার কম, তাঁদের ৫৬ দশমিক ৯০ শতাংশ পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে, ৩২ দশমিক ১২ শতাংশের আয় কমে গেছে। যাঁদের আয় ১৫ হাজার টাকার মধ্যে, তাঁদের ২৩ দশমিক ২ শতাংশের আয় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ৪৭ দশমিক ২৭ শতাংশের আয় কমে গেছে। আর যাঁদের আয় ৩০ হাজার টাকার বেশি, তাঁদের ৩৯ দশমিক ৫ শতাংশের কমেছে এবং ৬ দশমিক ৪৫ শতাংশের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এই সময়ে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। কমপক্ষে মাধ্যমিক পাস এমন নাগরিকদের ওপর এই জরিপ করা হয়। জরিপে অংশ নেওয়া পুরুষ ও নারীর অনুপাত ৬৭:৩২।

চাকরি আছে কিন্তু বেতন নেই
এক চলতি গবেষণায় ব্র্যাক দেখায়, চাকরি আছে বেতন নেই, এমন লোকের সংখ্যা বাড়ছে। তাঁরা শহরে টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। ১৩ ভাগ লোক, যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁরা প্রতি মাসে নিয়মিত বেতন পেতেন। তাঁরা দিনমজুর বা অনানুষ্ঠানিক কোনো কাজের সঙ্গে যুক্ত নন। আর আনুষ্ঠানিক খাতে চাকরি আছে কিন্তু বেতন পাচ্ছেন না, এ রকম কর্মজীবীর সংখ্যা অনেক। ২৫ ভাগের বেতন ৫০ থেকে ৩৫ ভাগ কমানো হয়েছে।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কে এ এস মুরশিদ বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তারা ৮০ ভাগ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন। এখন সরকার যে প্রণোদনা দিচ্ছে, সেটা তাঁদের জন্য যথেষ্ট নয়। আর প্রণোদনার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত চাকরি টিকিয়ে রাখা এবং নতুন কর্মসংস্থান তৈরি করা। সেটার আমরা ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। আমাদের যা সম্পদ আছে, তা দিয়েই কাজ করতে হবে। দরকার সম্পদের সঠিক ব্যবস্থাপনা।’ এই অর্থনীতিবিদ বলেন, যাঁরা ফরমাল সেক্টরে চাকরি করেন, তাঁদের বড় একটি অংশ এখন বিপাকে আছে। তাদের আয় কমে গেছে অথবা একটি অংশের আয় নেই। দরিদ্রদের জন্য সরকার কিছুটা হলেও খাদ্য বা অর্থসহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু এই জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের কোনো কর্মসূচি নেই।

দুমড়ে গেছে মধ্যবিত্তের কাঠামো
মুদ্রার রিজার্ভ, জিডিপি, ঊর্ধ্বমুখী ইমারত, বড় বড় ওভারব্রিজ, মেট্রোরেল যে জীবনমানের প্রকৃত নির্দেশক নয়, তা এখন করোনার সময় আরও আলগা হয়ে গেছে।
অভাবনীয়ভাবে মধ্যবিত্ত ক্ষতবিক্ষত ও জর্জরিত অনেক বেশি। দীর্ঘকালের তিলে তিলে গড়ে তোলা সংসারটিকে তারা তুলে দিচ্ছে পিকআপে। ফিরে যাচ্ছে গ্রামে। অনেকদিন আগে যে গ্রাম ছেড়ে এসেছিলে। কথা হচ্ছে, সেখানেও তাদের সামনে অপেক্ষা অনিশ্চয়তা। একদল ফিরে গেছে বাড়ি। বাকিরা লড়ছে এখনো এই শহরে। স্রেফ টিকে থাকার সংগ্রাম।

ভোগবাদী এই সমাজে মধ্যবিত্ত প্রায় সব সময়ই বিপদে ছিল। তাদের টিকে থাকাই ছিল কঠিন। জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে তাদের মানিব্যাগ বড় হয়নি। পরিবারের সদস্যদের চাওয়া–পাওয়ার অনেক কিছুই পূরণ হয়নি। যদিও তাঁদের কেউ কেউ নাম লিখিয়েছেন উচ্চবিত্তের খাতায়। কেউবা এমন জীবনে অভ্যস্ত হয়েছেন, যার জোগান এখন আর দিতে পারছেন না। যে স্বল্পসংখ্যক বিত্তের চূড়ায় উঠেছেন, বেগমপাড়ায় ঘরবাড়ি করেছেন, তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু চিরকালীন মধ্যবিত্তের যে জীবন, তা সব সময়ই কঠিনতম।

মার্চের শেষ সপ্তাহে সাধারণ ছুটি বা লকডাউন শুরুর পর সবচেয়ে বিপর্যয়ে পড়ে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষ। তাদের বেশির ভাগই নিজেদের জীবিকা হারিয়ে ফেলে। অনেকে শহর ছেড়ে চলে যায়। এসব নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে দাঁড়াতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ দেখা যায়। মধ্যবিত্তের ওপর আঘাতটা আসে আরেকটু পরে। সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শেষে তারা দেখে, হাতে কিছুই নেই। পরিবর্তিত সময়ে তারা সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়ছে বাসাভাড়া মেটাতে গিয়ে। এমনিতে তাদের টালি খাতার হিসাব মেনে চলতে হয়, যা বেতন পায় দেখা যায় তার অর্ধেক চলে যায় বাসাভাড়া মেটাতে। বাকি অর্ধেকে টেনেটুনে চলে। কিন্তু এমন মধ্যবিত্তের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন।

তাঁদের জন্য এই শহরে টেকা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বেতন আটকে গেছে অনেক প্রতিষ্ঠানে। কেউবা দুই মাসে একবার বেতন পেয়েছেন। বেতন কমে গেছে অনেকের। এমনকি কয়েকটি ব্যাংকও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন কমিয়েছে। অথচ কয়েক বছর ধরে ব্যাংকের চাকরিকে অন্যতম আকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বলা হচ্ছে, সরকারি চাকরিজীবী ছাড়া কেউই আসলে ভালো নেই।

লাখের বেশি পরিবার ঢাকা ছেড়ে গ্রামে
ঢাকায় চলার পথে একটু দৃষ্টি দিলেই দেখতে পাবেন টু-লেটের ছড়াছড়ি। বাসাভাড়ার এত বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞাপন আগে কখনো দেখেনি এ শহরের মানুষ। কিছু কিছু মহানুভব বাড়ির মালিক অবশ্য মহামারির এই সময়ে ভাড়া নিজ থেকেই কিছুটা কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু এসব ব্যতিক্রমই। ভাড়াটেদের জীবন ওষ্ঠাগত। তাঁদের কেউ কেউ অপেক্ষাকৃত কম ভাড়ায় নতুন বাসায় উঠেছেন। অনেক বাড়িওয়ালাও রয়েছেন বিপাকে। এমন সময়ে ভাড়াটেও পাচ্ছেন না তাঁরা। ঢাকা ছেড়ে দেওয়া আর নতুন বাসায় ওঠার বাইরেও পাওয়া যাচ্ছে আরেক ধরনের খবর। কঠিন এ সময়ে জীবিকার টানে পেশা পরিবর্তন করেছেন কেউ কেউ। নানা ক্ষুদ্র ব্যবসায় নিজেদের জড়িয়েছেন তাঁরা। যে পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হয় না আগামী ১-২ বছরের মধ্যে দেশের মানুষ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। পরিবারগুলোতে লেখাপড়া, চিকিৎসা, খাবারসহ সবকিছুতে সংকট দেখা দেবে।

ভালো নেই বাড়িওয়ালারাও
যাঁরা কিনা বহুদিন ধরে জীবন–জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় বসবাস করছিলেন পরিবার-পরিজন নিয়ে, তাঁরা এরই মধ্যে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা শহরের অনেক বাড়িতেই বেড়ে গেছে ঝুলে থাকা টু-লেটের বিজ্ঞাপন। অনেক বাড়িতেই ভাড়াটে নেই বলে একাধিক ফ্ল্যাট খালি। ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন অনেক বাড়ির মালিক, কিন্তু ভাড়াটে পাচ্ছেন না। বাড়ির মালিকদের আয় কমে গেছে ৫০ ভাগের কাছাকাছি।

কর্মসংস্থান ধরে রাখার নেই কোনো সরকারি পন্থা
অর্থনীতিবিদ রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, শুধু স্বল্প আয়ের মানুষ নয়, মধ্য আয়ের মানুষসহ দেশের সব মানুষই এখন বিপদগ্রস্ত। দেশের বড় অংশের মানুষ ব্যক্তি খাতে কাজ করে থাকে। একদিকে মানুষ চাকরি হারিয়ে গ্রামে চলে যাচ্ছে। অন্যদিকে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাপের মুখে পড়েছে। যেখানে গ্রামের মানুষ জীবন মান উন্নয়নের জন্য ঢাকায় আসে, সেখানে তারা ঢাকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। তারা কর্মসংস্থান চায়, সেখানে কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়ে আসছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা এমনিতেই বেশি ছিল। এ অবস্থায় নতুন করে হাজারো মানুষ বেকার হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আমরা শুধু প্রতিষ্ঠানকে দোষ দিচ্ছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কী করবে? প্রতিষ্ঠান তো ব্যক্তির। সমস্যাটা হলো, দেশের যে কর্মসংস্থান ছিল, তা ধরে রাখার জন্য সরকারের চলমান কোনো পদ্ধতি নেই। কর্মসংস্থান ধরে রাখার পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

সারকথা
মানুষ ভালো নেই মানসিকভাবে। ভালো নেই আর্থিকভাবে। পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে গেছে। সংকট কেটে মানুষ যেন আবার ব্যাসার্ধ নিয়ে মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে, সে যেন পারে ঘুরে দাঁড়িয়ে সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠে মন খুলে হাসতে, এটাই এখন মানুষের বড় অগ্রাধিকারের চাওয়া। আশাবাদেই সান্ত্বনা, মানুষ তুমি ঘুরে দাঁড়াও।
লেখক: উন্নয়ন