শিক্ষার মাইন্ডসেটে প্রয়োজন যে পরিবর্তন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ময়রার সন্তান মিষ্টির রূপ-রস-গন্ধ ও স্বাদের সঙ্গে ছোটবেলাতেই পরিচিত হয়। সাধারণত ময়রার সন্তান ময়রা হলে তার হাতের মিষ্টি একটি ‘ব্র্যান্ড’ হয়ে যায়। আমরা ওই ব্র্যান্ডের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলি, ওটা তাদের বাবা-দাদা চৌদ্দ পুরুষের মিষ্টি। সেটি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে পারিবারিক ব্র্যান্ডিং হয়ে যায়। যেমন শুনি, ঘোষ অ্যান্ড সন্স অথবা ঘোষ অ্যান্ড গ্র্যান্ড সন্স। নরসুন্দরের ছেলে নরসুন্দর হবে, জেলের ছেলে জেলে—সব ক্ষেত্রে পেশার লিগেসি বা এই বংশানুক্রমিক ধারাবাহিকতা কাম্য নয় বরং কোথাও কোথাও সেটি নাকচযোগ্যও বটে। নয়তো একটি বড় জনগোষ্ঠীর আর্থিক দুর্গতি কোনো দিন ঘুচবে না, পেশার বৈচিত্র্যও তৈরি হবে না।

যা হোক, আমাদের আজকের আলাপের জায়গাটি ভিন্ন। পেশার পারিবারিক ধারাবাহিকতা সম্পর্কে অনেক সময়ই বলি, একটি জায়গায় আটকে থাকব না, বের হয়ে যাব। এ ধরনের অনুপ্রেরণাদায়ক কথার পেছনে আরেকটি সত্য লুকিয়ে থাকে। সেটি হলো মাইন্ডসেট। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাইন্ডসেট গড়ে ওঠে বলেই কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ বা একাডেমিক সনদ না থাকলেও একজন মানুষ দক্ষ তাঁতি হিসেবে আবির্ভূত হন। খাদ্য ও পুষ্টি প্রকৌশলে না পড়েও খাবারের পুষ্টিজ্ঞান নিয়ে অনেককেই বেড়ে উঠতে ও সমাজে স্থান করে নিতে দেখি মাইন্ডসেট ও আগ্রহের জোরেই। জ্ঞানের কোনো বিশেষ শাখায় দক্ষতা তৈরির পূর্বশর্ত হলো সেই বিষয়ের প্রতি আগ্রহ, ভালোবাসা ও আন্তরিকতাবোধ নিয়ে মনস্থির করা।


কবিতায় আছে, ‘মা যদি হও রাজি, বড় হলে আমি হব, খেয়াঘাটের মাঝি।’ ছোটবেলা থেকে নদী ও নৌকার সঙ্গে সখ্য ওই কিশোরকে মাঝি হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। এই অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসা মাঝি হতে তাকে সামনের দিকে এগিয়ে নেবে। অনেক ক্ষেত্রে ছেলেবেলা থেকে জেলের ছেলের একটি মাইন্ডসেট তৈরি হয়ে যায় যে আমি জেলে হব। হয়তো সে জালটা তখনো ছুড়তে শেখেনি ঠিকভাবে, কিন্তু দেখে হোক বা প্রয়োজনে হোক, ওই পেশার প্রতি একটি টান তৈরি হয় তার ভেতরে ভেতরে। ময়রার ছেলে তখনো মিষ্টি বানাতে শেখেনি, কিন্তু তার মিষ্টি বানানোর মানসিকতা তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। এই মানসিকতা তৈরি হওয়ার সঙ্গে দক্ষ হয়ে গড়ে ওঠার যে সম্পর্ক আছে, সেই বিষয় নিয়ে আজকের লেখা। শিক্ষা বা জ্ঞানের বিশেষ বিশেষ বিষয়ের সঙ্গে যদি আন্তরিকতা ও মধুর সম্পর্ক গড়ে না ওঠে, তবে শুধু ট্র্যাডিশনাল স্কুলিং, সনদ—এককথায় আমাদের পুরো আয়োজন সফল হবে না।

প্রাচীনকাল থেকে মানুষের মধ্যে দক্ষতার আগে যে বিষয়টি স্থান করে নিয়েছিল, সেটি হলো মানসিকতা। এই মানসিকতা পারিবারিক ও ঐতিহ্যগতভাবে মানুষের মধ্যে প্রবহমান। আজকের পৃথিবীতে আমরা দেখি, একজন শিক্ষার্থী প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা করে, মেডিকেল সায়েন্সে পড়াশোনা করে, কিন্তু ওই বিষয়ে পড়ার মানসিকতা তার তৈরি হয় না। ফলে দেখা যায়, অনেক এমবিবিএস চিকিৎসক আছেন, যারা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারে যেতে চান, কেউ পুলিশ হতে চান। বহু প্রকৌশলী রয়েছেন যাঁরাও একই পথের পথিক। এর অর্থ দাঁড়ায়, শিক্ষাক্ষেত্রে মানসিকতা তৈরিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। যে বিষয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা করাই, শেখাই, সে বিষয়ে মানসিকতা তৈরির অভাবে সারা দেশে যে মানের জনশক্তি তৈরির কথা ছিল, যে সামর্থ্য তৈরি হওয়ার কথা ছিল, সেই লক্ষ্য পূরণ হয় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি বিভাগে বিভাগ–সংশ্লিষ্ট মানসিকতা তৈরি হলে প্রয়োজনীয় দক্ষতা-যোগ্যতা-জ্ঞান—সবকিছু মিলিয়ে একজন শিক্ষার্থী বেড়ে উঠবে, গড়ে উঠবে, নিজেকে তৈরি করবে। সেই সমন্বয় সৃষ্টি না হলে মানুষ শুধু বাহ্যিক আচরণ দিয়ে অনেক কিছু অর্জন করার চেষ্টা করে। তার ভেতরে ‘সিম্পলিসিটির’ অভাব তৈরি হয়। স্মার্টনেস বা অনেক সময় কথিত সফট স্কিলসের নামে আমরা তাদের যোগ্যতাহীন বা অভিজ্ঞতাহীন বাহ্যিক আবরণসম্পন্ন মানুষ তৈরি করি। ফলে দেশে প্রকৃত অর্থে টেকনিক্যাল স্কিলড লোকের অভাব দেখা দেয়। অন্য দেশ থেকে লোক আনতে হয়। কারণ, ওই নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে, দক্ষ হয়ে গড়ে উঠে একটি ‘অথরিটি’ গ্রহণ করতে হবে, সেই মানসিকতাও অনেক ক্ষেত্রে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে তৈরি হয় না।

দেশে এখন সরকারি-বেসরকারি অর্থায়নে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দিচ্ছে কিন্তু শিল্পকারখানায় বা দেশের উন্নয়নে যে ধরনের লোক প্রয়োজন, তা তৈরি হচ্ছে না। একদিকে আমাদের নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান বলছে তারা প্রয়োজনমতো জনবল পাচ্ছে না, অন্যদিকে গ্র্যাজুয়েটরা বলছেন বাজারে চাকরি নেই। এই দুইয়ের মধ্যে একটি সম্পর্ক ও সমন্বয় তৈরি হতে হবে। সে ক্ষেত্রে সুন্দর মাইন্ডসেট তৈরিই এখানে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের মাইন্ডসেট নিয়ে কাজ করার আগে মাইন্ডসেট পরিবর্তনকারীদের মাইন্ডসেট নিয়ে বিস্তর কাজ করার প্রয়োজন রয়েছে। বিভাগ-ডিসিপ্লিন নির্বিশেষে সব গ্র্যাজুয়েটকে যদি দিন শেষে বিসিএসের পেছনে ছুটতে হয়, তবে প্রচলিত ধারার শিক্ষার পেছনে সরকারি-বেসরকারি এত এত অর্থ খরচের উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়। এসব গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে আমাদের।


লেখক: স্টুডেন্টস অ্যাফেয়ার্স পরিচালক, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি