১৮৩ বছরে কুমিল্লা জিলা স্কুল, স্বপ্নের বীজ বোনা চলুক নিরন্তর

এ বছর জন্মদিনের লোগো।
এ বছর জন্মদিনের লোগো।

‘সময় সকাল ছয়টা। নিয়ম করে এ সময় উঠে যেতে হতো। কারণ, ঘণ্টাখানেক পরই যে দাঁড়াতে হবে স্কুলের প্রাত্যহিক সমাবেশে। নির্দিষ্ট সময়ের পর গেট বন্ধ হয়ে যাবে। দেরি করে পৌঁছানোর মাশুল হিসেবে শাস্তিও ভাগ্যে জুটে যেতে পারে।’

নিয়মের এমন কড়াকড়ির মধ্যেই প্রতিটি সকাল দেখার, সুনসান নীরবতা খেলা করা শহুরে রাস্তা আর পাখিদের ঘুমভাঙা গান কানে মেখে স্কুলে যাওয়ার অভ্যাস জন্মে যায় সাদা ইউনিফর্ম পরা প্রত্যেক ছাত্রের।

কুমিল্লা জিলা স্কুল। একাডেমিক শিক্ষার সাফল্য ছাড়িয়ে ক্রমেই মানুষ হওয়ার এমন নৈতিক শিক্ষারও সুতিকাগার হয়ে উঠেছে এই স্কুল। ১৮৩৭ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত সরকার শিক্ষা প্রসারের যে মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, ১৮৩ বছর পর এসে সেই উদ্দেশ্যের ধারাবাহিক বাস্তবায়নের অনন্য দৃষ্টান্তের প্রতিচ্ছবি যেন ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠ। ২০ জুলাই প্রতিষ্ঠার ১৮৪তম বর্ষে পদার্পণ করছে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই স্কুল।

যে উদ্দেশ্য নিয়ে কুমিল্লার ধর্মসাগরসংলগ্ন প্রাচীন এই বিদ্যালয়ের পথচলা শুরু, সেই উদ্দেশ্যে কতটা সফল এই স্কুল?

স্কুলের স্বর্ণযুগের স্থপতি নূর আহম্মদ খানের কথাই বলতে হয় শুরুতে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তাঁর মেধা ও শ্রমে স্কুলের শৃঙ্খলা ও শিক্ষার মানকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন যে সারা বাংলায় ‘কুমিল্লা জিলা স্কুল’ ১৯৬৯-৭০ সালে ‘শ্রেষ্ঠ স্কুল’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। সেই সঙ্গে তাঁর কর্মকুশলতার পুরস্কার হিসেবে ১৯৭০ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মাধ্যমিক স্কুলের শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক সম্মানে ভূষিত হয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদক (স্বর্ণপদক) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের পর কুমিল্লা জিলা স্কুল কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডে সেরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। এসএসসিতে গত ২০ বছরে ১৩ বার শতভাগ পাশের হার দেখেছে স্কুলটি।

২০০১ সালে সারা দেশে প্রথমবারের মতো এসএসসিতে জিপিএ পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে বরাবরই কুমিল্লা বোর্ডে ধারাবাহিক সাফল্যের এক অনন্য নজির রেখে চলেছে এই স্কুল। সে বছর সারা দেশে ৭৬ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর মধ্যে একজন ছিলেন এই স্কুলের। এরপর সময় যত পেরিয়েছে, এ সংখ্যা বেড়েছে কল্পনাতীতভাবে। সর্বশেষ এ বছর ৩৭৯ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫২ জন সর্বোচ্চ ফল অর্জন করেছে। সাফল্যের এ ধারা অব্যাহত আছে ২০১০ সাল থেকে চালু হওয়া অষ্টম শ্রেণির জেএসসি পরীক্ষায়ও। এসএসসিতে ২০১১ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বোর্ড কর্তৃক সার্বিক সাফল্য বিবেচনায় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হতো। সেই পাঁচ বছরে প্রতিবারই বোর্ডসেরা হওয়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছে স্কুলটির ছাত্ররা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সব জিলা স্কুলের সঙ্গে তুলনায়ও বেশ এগিয়ে স্কুলের শিক্ষার্থীরা। এ বছর যেমন সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা ১৫টি জিলা স্কুলের জিপিএ-৫–এর ফল বিবেচনায় দ্বিতীয় স্থানে থেকেছে কুমিল্লা জিলা স্কুল। ২১৮ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ২১৭ জন জিপিএ-৫ পেয়ে তালিকায় শীর্ষে ছিল বগুড়া জিলা স্কুল।

একাডেমিক সাফল্যের গল্প পেরিয়ে বলি আরেক সাফল্য আর গর্বের গল্প। প্রায় পৌনে দুই শ বছর বহু শিক্ষার্থী কুমিল্লা জিলা স্কুলে নিজেদের শৈশবের শিক্ষা পেয়েছেন। সেই শিক্ষায় আলোকিত হয়ে স্কুলকেই নিয়ে গিয়েছেন গর্বের জায়গায়। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন পরে বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় বাংলা ও হিন্দি গানের কিংবদন্তি জনপ্রিয় সংগীতজ্ঞ শচীন দেব বর্মণ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রথম নকশাকার শিব নারায়ণ দাস ছিলেন স্কুলের ১৯৬৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদ এই স্কুলে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করেছেন। ছন্দকার, কবি, গীতিকার, গায়ক, সাহিত্যিক, খেলোয়াড়, বিচারক, রাজনীতিবিদ—এমন করেই এই স্কুলের ছাত্রদের সাফল্য ছড়িয়েছে সব ক্ষেত্রে। যুগে যুগে বহু আন্দোলন, যুদ্ধ দেখেছেন এ দেশের মানুষ। তার প্রায় সব কটিতেই এই স্কুলের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবের সঙ্গে লড়াই করেছেন স্কুলের ১৩৮ শিক্ষার্থী; হয়েছেন শহীদ, বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব।

স্কুলের মূল ফটক। ফাইল ছবি
স্কুলের মূল ফটক। ফাইল ছবি

‘ক্লাস সিক্সে শ্রেণিশিক্ষক ছিলেন ওয়ালিউল্লাহ স্যার। বাকি পাঁচটা বছর কেমন যাবে মোটামুটি তার ওপর একটা ট্রেলার হিসেবেই ধরে নেওয়া যায় স্যারের ক্লাসগুলো। ক্লাসে কেউ চুল, নখ বড় রাখতে পারত না। কঠিন সব নিয়মের বেড়াজালে আটকে পড়লাম যেন!’ স্কুলের ২০১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আল-আমিন বলছিলেন স্কুলের নৈতিক শিক্ষার দিকটির কথা। দুই শিফটে প্রায় দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে এই স্কুলে। নানান নিয়ম আর বাধার দেয়ালের মধ্যেই চলে শিক্ষা গ্রহণের আয়োজন। স্কুলের অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর নৈতিক চিন্তাচেতনার জায়গাটিরও বিস্তৃতি ঘটাতে প্রতিনিয়তই চেষ্টা করে যাচ্ছে। নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারটি ভবিষ্যৎ জীবনে রাখে বড় প্রভাব। গর্বের জায়গাও হয়ে দাঁড়ায় কখনো। ২০১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী তানভীর মাহতাব আবীর বলছিলেন সেই কথাই, ‘জিলা স্কুল নিয়ে গর্বের জায়গাটা একটি গোল্ডেন জিপিএ-৫, বোর্ডে প্রথম হওয়া থেকে আরও অনেক উঁচুতে। এক জিলা স্কুলের জীবন থেকে যতটা না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া যায়, তার চেয়ে বেশি পাওয়া যায় বোধ হয় মানুষ হওয়ার মানবিক শিক্ষা। এই শিক্ষাই কাজে দেয় সারা জীবন। জিলা স্কুলকে গর্বের বিদ্যাপীঠ বলার কারণ তো এখানেই।’

প্রতিবছরই জন্মদিনে স্কুলপ্রাঙ্গণে দিনব্যাপী আয়োজন থাকে। তবে এবার করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবের কারণে স্কুল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে অনলাইনে সংক্ষিপ্ত জন্মদিন আয়োজন করা হয়েছে।

শুভ জন্মদিন, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে মানুষকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার এক অনন্য বাতিঘর, কুমিল্লা জিলা স্কুল। হাজারো স্বপ্নের বীজ বুনে দেওয়ার তোমার এমন প্রচেষ্টা চলুক নিরন্তর।


*লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী (২০১৩ ব্যাচ), কুমিল্লা জিলা স্কুল