ষড়যন্ত্রতত্ত্ব: নেপথ্যের কুশীলব এবং করোনা মহামারি

উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি। ফাইল ছবি
উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি। ফাইল ছবি

সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীব্যাপী বহুল আলোচিত বিষয় ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’। বিশেষ করে করোনা মহামারি ঘিরে এর ডালপালার বিস্তার ঘটেছে ব্যাপকভাবে। কী এই ষড়যন্ত্রতত্ত্ব? বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়ার আগে প্রথমেই আমাদের প্রয়োজন ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে সংজ্ঞায়িত করা।

কেমব্রিজ অভিধান অনুসারে, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব হচ্ছে একধরনের বিশ্বাস বা ধারণা। যার কারণে লোকে মনে করে, কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতি শক্তিশালী ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ দ্বারা তৈরি গোপন পরিকল্পনার ফলাফল। সাধারণত স্বার্থান্বেষী মহল তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে কোনো একটি ঘটনার কারণ হিসেবে গভীর কোনো গোপন ষড়যন্ত্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট প্রমাণ থাকে অনুপস্থিত।

স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন জাগে, কেন লোকে তবে এগুলো বিশ্বাস করে? কীভাবে এ রকমের তত্ত্ব লোকপ্রিয়তা পায়? সহজভাবে বললে, অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট প্রমাণের অভাবে মানুষ সাধারণত নিজের বিশ্বাসের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ধারণা বা মতামতের প্রতি আস্থাশীল হয়। এই যেমন, আধ্যাত্মিক অনেক ব্যাপারেই মানুষ মূলত তার বিশ্বাস দ্বারা প্রভাবিত হয়, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বিষয়গুলো এমন চটকদার ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা হয় যে অনেকেই প্রভাবিত হয়। অনেক সময় লক্ষ করা যায়, কোনো স্বনামধন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান এসব প্রচারে শামিল হয়, ফলে তথাকথিত ষড়যন্ত্রতত্ত্ব লোকপ্রিয়তা পায়। এডলফ হিটলারের তথ্যমন্ত্রী গোয়েবলসের সেই বিখ্যাত উক্তি এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, ‘একটি মিথ্যা বারবার বললে তা সত্য হয়ে যায়’। ষড়যন্ত্রকারীরা সাধারণত কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে বেছে নেয়, যাতে তারা সহজেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ হয়। মানুষ যখন কোনো বিষয়ে উদ্বিগ্ন বা অনিশ্চিত থাকে, কী ঘটতে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা না থাকে, তখনই এ ধরনের মিথ্যা রটনা তার ডালপালার বিস্তার ঘটায়। বর্তমানে ইন্টারনেট প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির কারণে চকিতে ছড়িয়ে যাচ্ছে তথাকথিত এসব তত্ত্ব।

ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মোটেও সাম্প্রতিক বিষয় নয়, সুদূর অতীতেও এর অস্তিত্ব খুঁজলে পাওয়া যায়। খ্রিষ্টপূর্ব ৩৩১ সালে রোমে একটি অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। হঠাৎ করে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অসুস্থতার শিকার হন এবং তাঁরা সবাই মৃত্যুবরণ করেন। ব্যাপারটা অল্প সময়ের মধ্যে মহামারি আকার ধারণ করে। এ সময়ে একজন দাসী প্রভাবশালী এক বিচারককে বলেন, তিনি এই রহস্যের কারণ জানেন। বিচারকের অনুমতিক্রমে, একদল তদন্তকারীকে সঙ্গে করে সেই নারী ঘরে ঘরে তল্লাশি শুরু করলেন। তল্লাশি শেষে তাঁরা দাবি করেন, সমাজের সম্ভ্রান্ত শ্রেণির কিছু নারী বিষ তৈরি করছিলেন এবং সেগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে মানুষ হত্যা করছিলেন। রোমের আইন অনুসারে, অভিযুক্ত নারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়। অভিযুক্তরা দাবি করেন, ওগুলো বিষ নয় বরং ঔষধি গুণসম্পন্ন মিশ্রণ। দুজন সেই মিশ্রণ পান করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ১৭০ জন নারীকে এই কাজে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। পরবর্তী সময়ে ঐতিহাসিকেরা সত্য উদ্‌ঘাটন করে বলেন, এক অজানা প্লেগ রোগের কারণে রোমে মহামারি দেখা দিয়েছিল, যার ফলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বর্তমানে পৃথিবীব্যাপী চলছে মহাদুর্যোগ। কোভিড-১৯ নামক এক মারাত্মক ভাইরাসের আক্রমণে পুরো দুনিয়া দিশাহারা। এ রকম ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখে মানুষ পড়েনি গত ১০০ বছরেও। এখন পর্যন্ত ১ কোটি ৩৫ লাখের বেশি মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত। এর মধ্যে ৬ লাখের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ঘটে ব্যাপারটা। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাইরাসটির প্রথম সংক্রমণ ঘটে চীনের উহানে। তারপরে দ্রুত ছড়িয়ে যায় পৃথিবীতে। এ রকম এক অস্থির সময়ে স্বাভাবিক কারণেই এই ভাইরাসের উৎপত্তি নিয়ে চলছে নানা রকমের অনুসন্ধান, আলোচনা ও গবেষণা। তৈরি হচ্ছে অনেক গল্প, জন্ম নিচ্ছে অনেক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। আর এসবের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার পাঁয়তারা করছে অনেক সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী; চেষ্টা চালাচ্ছে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার। এ রকম কিছু বহুল আলোচিত ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্বের’ উদাহরণ:
১.
নাটের গুরু চীন
এই তত্ত্বের প্রবক্তারা বলেন, করোনাভাইরাস প্রাকৃতিক নয়, এটি মানবসৃষ্ট। উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি এই ভাইরাসের আঁতুড়ঘর। জীবাণু অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে এই ভাইরাসের জন্ম। উহানের ওই ইনস্টিটিউট থেকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অথবা অসতর্কতার কারণে ভাইরাসটি ছড়িয়েছে। স্বয়ং মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিযোগ করেছেন, চীনের অসতর্কতার কারণে এমনটা ঘটেছে।
এ কথা সত্য, দীর্ঘদিন ধরে এই প্রতিষ্ঠানে ভাইরাস নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এটি চীনের একমাত্র লেভেল-৪ গবেষণাগার। যার অর্থ, এখানে রয়েছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তাব্যবস্থা। সুতরাং, এখান থেকে ভাইরাসটি ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে। আর এর সপক্ষে কেউ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। এ ছাড়া বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এটা প্রমাণিত যে ভাইরাসটি মানবসৃষ্ট নয়, অবশ্যই প্রাকৃতিক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বিভিন্ন সময়ে এ ধরনের গুজব নাকচ করে দিয়েছে।

প্রশ্ন ওঠে, কেন চীনকে জড়িয়ে তবে এ রকম একটা কথা ছড়ানো হলো? খোলা চোখে দেখলে চীনের সাম্প্রতিক সময়ের উত্থান অনেকেই সহজভাবে নেয়নি। চীনকে ঘায়েল করার উদ্দেশ্য থেকে এ রকম তত্ত্বের উদ্ভব হতে পারে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো করোনা মোকাবিলায় নিজের ব্যর্থতা আড়াল করতে চীনকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করেছেন। সামনেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং খুব স্বাভাবিক কারণে বিষয়টি নির্বাচনে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হতে পারে।
২.
মার্কিনিদের কাজ
চীনে যখন প্রথমে এই ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে, তখন মার্কিন বিরোধী পক্ষ বেশ জোরালোভাবে দাবি করেছে, চীনকে শায়েস্তা করতে আমেরিকান সৈন্যদের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়ানো হয়েছে। এমনকি চীনের এক সরকারি মুখপাত্র এর পক্ষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বক্তব্য দিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে চীনের পরে ইরানে করোনাভাইরাস দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং দেশটিতে ব্যাপক প্রাণহানি হয়। স্বাভাবিকভাবে এই তত্ত্ব কিছুটা জনপ্রিয়তা লাভ করে, কেননা ইরান মার্কিনবিরোধী দেশ হিসেবে পরিচিত। তবে যথারীতি এর সপক্ষে কেউ কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। এ কথা বলা ভুল হবে না যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মার্কিন বিদ্বেষকে পুঁজি করে কেউ কেউ হয়তো সহানুভূতি অর্জনের চেষ্টা করেছে।
৩.
দায়ী বিল গেটস

বিল গেটস। ফাইল ছবি
বিল গেটস। ফাইল ছবি

বিল গেটসকে দায়ী করে একটি প্রচারণা হালে বেশ পানি পেয়েছে। ২০১৫ সালে কানাডার ভ্যাংকুভারে এক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী কয়েক দশকে যদি কোনো কিছুতে এক কোটি লোকের মৃত্যু হয়, সেটা হয়তো হবে অত্যন্ত সংক্রামক একটা ভাইরাস, কোনো যুদ্ধ নয়।’ তখন কেউ-ই ও বক্তব্য আমলে নেয়নি। তবে এখন একপক্ষ ২০১৫ সালে দেওয়া বক্তব্যের সূত্র ধরে বলছে, বিল গেটসের নেতৃত্বে এক অশুভ শক্তি এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। কারণ, তাঁরা জানতেন, কার্যকরী কোনো টিকা ছাড়া এই ভাইরাস থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। আর তাঁরা চাচ্ছিলেন এই টিকার ওপর তাঁদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ থাকুক, যাতে তাঁরা বিপুল পরিমাণে মুনাফা অর্জন করতে পারেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, এ রকম প্রচারের উদ্দেশ্য কী? সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসনের নেওয়া কিছু পদক্ষেপ নিয়ে বিল গেটস ভিন্নমত পোষণ করেন। হতে পারে এতে ট্রাম্প প্রশাসন তাঁর ওপরে ক্ষুব্ধ ছিল। টিকার বিষয়ে বিল গেটসের বক্তব্যে অনেকেই নাখোশ হতে পারে। শুরু থেকে তিনি এর বাণিজ্যিকীকরণের ব্যাপারে সতর্ক করে আসছেন।

ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে এত আলোচনা বা উদ্বেগের কী আছে? এ প্রসঙ্গে হুর মহাপরিচালকের একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘ভুল তথ্য সাধারণ মানুষের মনে দ্বন্দ্ব এবং ভীতির সঞ্চার করে। ডব্লিউএইচওতে আমরা শুধু ভাইরাসের বিরুদ্ধেই লড়াই করছি না, বরং এ নিয়ে ট্রল বা ব্যঙ্গ এবং ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিরুদ্ধেও লড়ছি, যা আমাদের পদক্ষেপকে দুর্বল করে দিচ্ছে।’
মহামারির বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে সবাইকে দায়িত্বশীল হতে হবে। সতর্ক হতে হবে যেকোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্বের বিষয়ে। অন্যথায় জীবাণুর বিরুদ্ধে এই লড়াই কঠিন থেকে কঠিনতর হতে পারে।

*লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। লালমাটিয়া, ঢাকা [email protected]