অনুভূতিগুলো যেন একেকটা গল্প

দিপা আজ হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে, হাতভর্তি কাচের চুড়ি, কপালে কালো টিপটা পরতেও ভোলেনি। হলুদ রং দিপার অনেক পছন্দ, তুহিন একদিন বলেছিল ‘হলুদ রঙে তোকে অনেক সুন্দর লাগে, দূর থেকেও মনে হয় জ্বল জ্বল করছিস।’ এই পাগলটা সহজেই সুন্দর লাগছে, এই কথাটা বলতে চায় না। কিন্তু দিপার অনেক ভালো লেগেছিল সেদিন, সেদিনের কথা মনে করেই দিপা আজকে হলুদ শাড়ি পরেছে।

সব সময়ের মতো আজকেও তুহিন দেড় ঘণ্টা দেরি করে এল, তুহিনের জন্য অপেক্ষা করতে দিপার ভালো লাগে। অনেক রেগে যায় দিপা, দিপাকে একা বসিয়ে রাখে তুহিন এ জন্য, কিন্তু তুহিনের মুখটা দেখলে দিপা আর কিছু বলতে পারে না। দিপাকে এভাবে সাজতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে থাকল, দিপা ব্যাপারটা বুঝেও অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল, সে চাইছিল তুহিন আজকেও এসে সুন্দর লাগছে কথাটা বলুক। কিন্তু পাগলটা নিজেকে সামলে নিয়ে কাছে এসে বলল, ‘কিরে তোর আজকে গায়ে হলুদ নাকি, এত সাজছিস কেন।’ এ বলে বোকার মতো হাসতে থাকল। দিপা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘ভাবিস না তোর জন্য সেজেছি, তুই আজকে আমাকে ছবি তুলে দিবি, সারা দিন ঘুরব, তাই শাড়ি পরেছি।’

‘এই শাড়ি পরে তুই কই যাবি, তুই শাড়ি পরে হাঁটতে পারবি?’—তুহিন।
‘শাড়ি পরে আমি দৌড়াতে পারব, তুই যাবি কি না বল’—দিপা।
“না, এই সব শাড়িটাড়ি পরা মানুষ নিয়ে আমি কোথাও যেতে পারব না, মানুষ আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে’—তুহিন।

থাকুক তাকিয়ে, ভাবুক মানুষ তুই বিয়ের আসর থেকে বউকে তুলে আনছিস, এই বলে দিপা সামনের দিকে হাঁটা শুরু করল, পেছনে আর তাকাল না। দিপা জানে তুহিন বিরক্তি নিয়ে বকবক করতে করতে ঠিকই পেছন পেছন আসবে।

রিকশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ভবনের পাশে যে ফুচকার দোকান আছে, সেখানে গিয়ে দিপা ফুচকা খেতে চাইল। ফুচকার কথা বলতেই তুহিন বলল এই জায়গায় তো আমার ৩ নম্বর প্রেমিকাকে নিয়ে আসছিলাম ফুচকা খেতে। তখনি দিপা রেগে গেল, সে আর ফুচকা খাবেই না, সজোরে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল, অমনি তুহিন পেছন থেকে হাত ধরে বলল, ‘আরে কই যাস, এত প্রেমিকা আমি কই পাব বল, মেয়েদের কি আর কোনো কাজ নাই, সব মেয়েই কি আমার প্রেমিকা নাকি, তোকে না রাগালে আমার ভালো লাগে না।’ রেগে গেলে দিপাকে দেখতে একটুও সুন্দর লাগে না, কিন্তু তুহিন কি যে মজা পায় দিপার এই বিচ্ছিরি রাগের চেহারাটা দেখতে, তা বুঝতে পারে না দিপা। কিন্তু এই পাগলটার পাগলামি ভালো লাগে দিপার।

তুহিন দিপাকে বলল, তোর জামাইটার জন্য মাঝেমধ্যে খারাপ লাগে, এত রাগ তোর। দিপা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আমি বিয়ে করব না, একাই থাকব।’ অমনি তুহিন বলে উঠল, ‘আমি তো করব, পরির মতন একটা মেয়ে পেলেই বিয়ে করব।’ অমনি দিপা আবার রেগে গেল, ‘আমি তোকে জিগ্যেস করেছি? বিয়ে করলে করবি, এত বলার কী আছে। আর বিয়ে করে বউকে কী খাওয়াবি?’
‘বিশুদ্ধ বাতাস’—তুহিন। তুহিন হাসে...

তুহিনের হাসিটা দিপার ভীষণ ভালো লাগে। তুহিনের হাসিতে কেমন যেন একটা মায়া আছে, বাচ্চা বাচ্চা লাগে। তুহিনের সঙ্গে সবুজ ঘাসে পা গুটিয়ে গল্প করতে যে শান্তি পায়, উঁচু দালানকোঠায় এসির বাতাসে দিপা সে শান্তিটা খুঁজে পায় না। দিপা তুহিনের দিকে তাকিয়ে থাকে আর তুহিন দিপার আশপাশে আসা মশাগুলোকে তাড়াতে থাকে।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে এল, তুহিন বলতে থাকল, ‘যা বাসায় চলে যা, সন্ধ্যার পর শাড়ি পরা মেয়েদের জিনে ধরে। কী সব পরে যে আসিস তুই।’ কিন্তু দিপার তো আজ বাসায় যেতেই ইচ্ছা করছে না। ইচ্ছা করছে পুরো ঢাকা শহরটা তুহিনের হাত ধরে রিকশা নিয়ে ঘুরতে, যতবার রিকশা নিয়ে ঘুরেছে তুহিন আশপাশে দেখত, এই বুঝি কেউ দেখে ফেলল, আর সেই চেহারাটা দেখতেই দিপার বেশি মজা লাগত। যেদিন দুজনের প্রথম দেখা হয়েছিল, সেদিনও রিকশায় ঘুরেছিল, নিজে আগে রিকশায় উঠে দিপাকে যখন রিকশার ডান পাশে বসতে বলেছিল, সেদিনই দিপা বুঝে গিয়েছিল এই পাগলটা কোনো দিন বোধ হয় ঠিকমতো প্রেম ও করেনি। জানেই না মেয়েদের রিকশার বাঁ পাশে বসাতে হয়।

দিপার খিদে পেয়েছে। তুহিনের কাছে জেদ ধরল আজকে দেরি করে বাসায় ফিরবে, আমাকে আজকে খাওয়া। ‘ওই সব বিদেশি খাবার আমি খাওয়াতে পারব না, ভাত যদি খেতে চাস তাহলে খাওয়াতে পারি’—তুহিন।

দিপা কখনো হোটেলে বসে ভাত খায়নি, কিন্তু তুহিনের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ থাকার লোভটা সামলাতে পারল না। তুহিনের সঙ্গে ভাত খেতে বসল। হোটেলের মানুষজন ঘুরেফিরে দিপাকে দেখছে, দিপার খুব অস্বত্বি লাগছিল, কিন্তু তুহিনকে বুঝতে দিল না, কারণ তুহিন রেগে যায় রাস্তায় যদি কেউ দিপার দিকে একটু অন্যভাবে তাকায়। তুহিনের এই অভ্যাসটাও দিপার অনেক ভালো লাগে, নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ জায়গায় আছে মনে করে যখন তুহিনের সঙ্গে থাকে।

তুহিন খুব মন দিয়ে ভাত মাখাচ্ছিল, খুব খিদে লেগেছিল বোধ হয়। এত মায়া লাগছিল দেখতে, দিপা বলে উঠল, ‘তোর সঙ্গে এই প্রথম ভাত খাচ্ছি, আমাকে প্রথম তুই খাইয়ে দিবি।’ তুহিন হাঁ হয়ে গেল।

‘পাগল নাকি তুই, এ আবার কেমন কথা, মানুষ কী বলবে’—তুহিন।
‘মানুষ যা বলার বলুক, তুই না খাইয়ে দিলে আমি খাব না’—দিপা।

মন খারাপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে ভাতগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল, হঠাৎ তুহিন বলে বসল, ‘ঢং বাদ দিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁ কর।’ দিপার চোখ খুশিতে ছলছল করছিল। সেদিন দিপাকে বাসার সামনে যখন তুহিন নামিয়ে দিল, দিপার পা দুটো কেমন যেন অবশ হয়ে আসছিল, পা সামনের দিকে আগাচ্ছিল না। যদি আর কখনো না দেখা হয়। তুহিনের সঙ্গে প্রতিবার বিদায়ে দিপার এমন লাগে। কান্না পায়, ইচ্ছা করে জড়িয়ে ধরে বলতে ‘তুই কেন কিছু বুঝিস না, নিয়ে যা না আমাকে তোর কাছে।’

কিন্তু তুহিন ছেলেমানুষি পছন্দ করে না। ‘বাসায় গিয়ে ফোন দিস’—এ কথা বলে দিপা তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে গেল। কারণ, দিপা জানে গেট দিয়ে না ঢোকা পর্যন্ত তুহিন দাঁড়িয়ে থাকবে।

কিছু কিছু সম্পর্কে কখনো ভালোবাসি বলতে হয় না, সম্পর্কের পরিণতিটা কী হবে, কোথায় যাবে কেউ জানে না, কিন্তু একসঙ্গে থাকতে ভালো লাগে, ঝগড়া করতে ভালো লাগে, ছোট ছোট অনুভূতি যেন এক একটা গল্প, এমন নাম না–জানা সম্পর্কই এই তুহিন আর দিপার।

পরবর্তী জীবন বলে কিছু নেই, জীবন মানেই বর্তমান! একটু পরেই আমরা বেঁচে থাকব কি না, তা কেউ জানি না। তবে পরকাল ভিন্ন কথা। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি পরবর্তী জীবনের।