করোনায় ভয়ংকর ১২৯ দিন

‘১২৯’ সংখ্যাটা সংখ্যার দিক দিয়ে তেমন একটা বড় না হলেও জীবনে গভীর দাগ কেটে দেওয়ার জন্য, জীবন থেকে অনেক কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য, একটি বন্দিজীবনের জন্য ‘উপযুক্ত দিনের সংখ্যা’ হিসেবে কিন্তু অনেক বড়। ছোট এই জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ‘ভয়ংকর সেই ১২৯ দিন’ অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। সেই হৃদয় তোলপাড় করা অনুভূতি কার নিকট কতটা রসালো, কতটা উপভোগ্য কিংবা কতটা তিক্ত এবং যন্ত্রণার, তা আমি জানি নাহ! তবে একজন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানের দৃষ্টিতে ‘সেই ১২৯ দিন’ কতটা তীক্ষ্ণ এবং কতটা গভীর রেখাপাত তৈরি করেছে তার ছোট্ট এক টুকরো ইতিহাস ফুটিয়ে তোলার সাফল্যের বৃথা চেষ্টায় কলমটা এগিয়ে যাচ্ছে।

কী জানি একটা এসেছে এ শহরে, চেনাজানা বা সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি ওটার সঙ্গে। কিন্তু ওই ‘বেয়াদপ’টা শহরে এসেই দাঙ্গা লাগিয়ে দিয়েছে। শুধু দাঙ্গাই নয়, শত্রুতা করে জীবনটাকেও নিয়ে গেছে অনেকের। লুকোচুরি আর কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলার মতো যাকে পাচ্ছে, তাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। আর এর ভয়ে সমগ্র শহর থমথম। অল্প সময়ের মধ্যে যে পরিমাণ মানুষের ভয় আর অন্ধ বিশ্বাস, এটি অর্জন করেছে তা যদি কেউ সৃষ্টিকর্তার ওপর করত তাহলে হয়তো এ পৃথিবীতে ওইটার আবির্ভাবই হতো না। পৃথিবীর চেহারাটা হতো আরও সুন্দর, আরও শান্তিময়...।

শুধু ভয়ের সঙ্গে ব্যাপারটা জড়িয়ে থাকলে তা হয়তো ওখানেই চুকে যেত। কিন্তু বিষয়টি শুধু ভয় আর শারীরিক রোগ সৃষ্টির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে সমগ্র মানুষের নিত্যদিনের পথচলা, শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা সৃষ্টি করে সেই ‘কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন’–এর ধারে বসে থাকা পথশিশুটির অমায়িক সুন্দর মুখের হাসিটিও কেড়ে নিয়েছে। সেখানে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকাটা নেহাত বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

ধনী, গরিব আর মধ্যবিত্ত—তিন শ্রেণির মানুষ কিন্তু আজ এক দৃষ্টিকোণ থেকে সমান, ‘সকলেই আমরা বন্দী।’ তবে ধনীদের এক দিক দিয়ে পেরেশানি কম। অন্তত তিন বেলায় পাকস্থলীতে কিছু ঢালার মতো সামর্থ্য তাদের আছে। আর গরিব ভাইয়েরা আমার। তাদের পাকযন্ত্রটা ধ্রুবকই রয়ে গেছে। কেননা বন্দী দশার আগেও তারা যে খুব একটা খেতে পেয়েছেন, তা নয়। মধ্যিখানে চাপা পড়ে গেছে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগুলো, আমরা আজ আত্মসম্মানবোধের কারণে পেটের ক্ষুধাকে বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছি। গরিব–অসহায়ের মতো না কারোর কাছে হাত পাততে পারি, না ধনীদের মতো কয়েক মাসের রসদ একসঙ্গে কিনে ফ্রিজ গাঁদাতে পারি, ফলাফল—ক্ষুধার্ত।

পড়াশোনার জন্য অনলাইন শিক্ষাব্যবস্থা নিঃসন্দেহে অতি উত্তম পদ্ধতি। তবে পড়াশোনাকারীদের অধিকাংশই যে মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য, তা হয়তো সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীরা ভুলে গেছেন। যুগ এখন বিজ্ঞানের যুগ। এখন অনেক উন্নত। কিন্তু টানাপোড়েনের সংসারে সব নিত্যপ্রয়োজন পূরণ করে দিনশেষে ৩০ টাকায় ১ জিবি কেনার মতো সামর্থ্যও যে কিছু মানুষের নেই, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। আর ওয়াই–ফাই—হা হা হা, সেটাও তো বিলাসিতা।

যেখানে আশপাশের সহপাঠীরা জ্ঞান অর্জনের তুমুল প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে, সেখানে এই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানগুলোর অনেকে হয়তো অর্থাভাবে শ্রেণির বইগুলোই কিনতে পারেনি। কারণ, বই কিনবে না ক্ষুধা মেটাবে? আপনার কাছে হয়তোবা এটা সিনেমার কাহিনি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, বুকে হাত রেখে বলছি, আজ এটাই চরম বাস্তবতা এবং আমরা সেই চরম বাস্তবতার কঠিন শিকার। পেটে পাথর বেঁধে ওপরে পোশাকের আবরণ দিয়ে হয়তো ‘ভরা পেট’ উপস্থাপন করাই যায়। কিন্তু সেই ক্ষুধার আর্তনাদ বহিষ্কৃত হয় না। দিনের পর দিন হয়তো এভাবেই তাদের চলতে হচ্ছে সমাজের মানুষগুলোর সামনে, কিন্তু তা জানে কয়জন? মুখে একচিলতে হাসি ধরে রেখে ভেতরের কষ্টটাকে আড়াল করে ভালো থাকার অভিনয় করতে জানে না ধনীরা, জানে না গরিবেরা, জানি শুধু এই মধ্যবিত্ত আমরা...।

রিকশায় করে ধনী আংকেলরা যখন সারা মাসের বাজার করে নিয়ে ঘরে ফেরেন, সবাই সে রসদ দেখে, নিজেদেরও বাজার করতে হবে, এমন চেতনায় উন্নীত হয়। কিন্তু একবারও চেয়ে দেখে না সদাই কেনার সময় রিকশাওয়ালার আলু, চাল, ডালগুলোর দিকে নিক্ষিপ্ত সেই নিথর দৃষ্টি চোখ ফেটে বের হতে চাওয়া সেই অঝোর অশ্রু, পেটে থাকা ক্ষুধার হাহাকার কিন্তু এগুলো কেনার সামর্থ্য তাঁর নেই। তাঁর রিকশাই আজ বাজারে ভরপুর, কিন্তু তাঁরই বয়ে নেওয়া বাজারে তাঁর বিন্দুমাত্র হক নেই। তাঁর এই বয়ে নেওয়ার বিনিময় মূল্য ২০ থেকে ৩০ টাকা, এটাই তাঁর অর্জন।

আর হাজারো কর্মব্যস্ততায় থাকা মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহকর্তা, যিনি কিনা একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আজ একজন অলস ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। ঘরে স্যাভলন মেশানো পানি ছিটানো আর রুক্ষ হয়ে থাকা মেজাজ ঠান্ডা করার জন্য নানা অশান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া তেমন একটা কাজ তাঁর নেই এখন।

নিত্যদিন কর্মস্থল থেকে ফিরে আসা ক্লান্ত দেহ, বিশ্রামের অপেক্ষায় প্রহর গোনা চোখগুলো, যা সপ্তাহের ছুটির দিন শুক্রবারকে ঈদ সমতুল্য মনে করে, আজ তাঁরাও জানে না কবে শুক্রবার আসে আর যায় আজ প্রতিদিনই তাদের শুক্রবার।

জন্মের পর কখনো বাবা-ভাইকে মসজিদ ছাড়া জুমার নামাজ আদায় করতে দেখিনি। আজ সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। জীবনে প্রথমবারের মতো যেদিন বাবা-ভাইকে জুমার দিনে ঘরে জায়নামাজ বিছাতে দেখলাম, সেদিন কেন জানি না শরীরের ভেতর থেকে অস্পষ্ট একটা গোঙানি, চোখের কোনায় হালকা একটু জল অনুভব করেছিলাম।

কিন্তু জানেন? ক্ষুধার এই তীব্র কষ্ট, পড়াশোনার প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা সত্ত্বেও বই না থাকার কারণে, একটি ফোন না থাকার কারণে, শিক্ষকদের যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে না পারার কারণে হাজারো মধ্যবিত্ত শিক্ষার্থীর পূরণ হতে যাওয়া অপূরণীয় স্বপ্ন ভেঙে খান খান হওয়া, নিজ পরিবারের কেউ আবার আক্রান্ত হয় কি না, এর ভয়ে দিনরাত সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনার মাঝে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে, সেই মুক্ত দিনগুলো! খোলা আকাশ, শান্ত স্নিগ্ধ সকালে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজ যাওয়ার দিনগুলো! কলেজ ছুটির পর হঠাৎই আকাশ জমকালো হয়ে আসা গুড়ুম গুড়ুম মেঘের ডাকের সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যাওয়ার দিনগুলো! কাঁচা মাটি আর কদম ফুলের হালকা গন্ধ নাকে এসে লাগার সেই অনুভূতিটা তখন না একমুহূর্তের জন্য হলেও মধ্যবিত্ত পরিবারের সে মেয়েটা সব দুঃখ–কষ্ট ভুলে যায়, সবকিছু; সব সব সব। বন্দিজীবনের মধ্যেও একচিলতে আনন্দ সে খুঁজে পায়।

পথঘাট, গাছের পাতাগুলো, রাস্তার ইটগুলো, কুকুরগুলো এমনকি সেই ভেলপুরি বিক্রেতা ছোট ছেলেটাও হয়তো আজ তাকে ভুলে গেছে। তবু সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় বন্দী থাকার কারণে ওই ‘করোনা’ তাদের ছুঁতে পারেনি।

হারানো সেই দিন, হারানো সেই বিকেল, হারানো সেই জীবন জানি একদিন ঠিক ফিরে আসবে, আসবেই। তবে মধ্যবিত্তের জীবনে এই ‘১২৯ দিন’ যে গভীর ক্ষত তৈরি করে গেল, তা মুছে যাবে না কখনো...মধ্যবিত্তের এই ছোট্ট জীবনটায় ‘বেঁচে আছি’ এ সান্ত্বনার মাঝেই ভীষণ মনে পড়বে নিদারুণ কষ্টদায়ক ‘করোনার সে দিনগুলি’।

*লেখক: দ্বিতীয় বর্ষ, ভিকারুননিসা নূন কলেজ