'বঙ্গতাজ' পর্দার আড়ালের নায়ক

তাজউদ্দীন আহমদ
তাজউদ্দীন আহমদ

নিজের গুণগান প্রচার করা আমাদের অভ্যাস। আমি এটা করেছি, ওটা করেছি বা আমার জন্য এটা হয়েছে, ওটা হয়েছে। এমন প্রচার কে না চায়। আমি, আপনি সবাই এই প্রচারে বিশ্বাসী। কিন্তু তিনি ছিলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। মুখ ফুটে তাঁর কীর্তির কথা বলতেন না বা কাউকে বলতেও দিতেন না, তিনি দেশ ও দেশের জন্য পর্দার আড়ালে থেকে চুপিসারে কাজ করে যাওয়াকে নিজের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করতেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদানের কথা কাউকে বলতেও দিতেন না। বলছি একজন পর্দার আড়ালের সুপার হিরোর কথা। তিনি হলেন সবার প্রিয় বঙ্গতাজ তাজউদ্দীন আহমেদ। আজ ২৩ জুলাই। ক্ষণজন্মা এই মানুষটির আজ জন্মদিন। বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন তিনি কিন্তু অন্যদের মতো নেই তাঁর প্রচারণা। তবু নতুন প্রজন্ম মনে রেখেছে তাঁকে।

তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর মেধা, দক্ষতা ও বিচক্ষণতার জন্য মাত্র ৯ মাসেই যুদ্ধে জয় পেয়েছি আমরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে তিনিই দিয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশনা। এত কিছু করার পরও কখনো তিনি বলেননি যে আমি এটা করেছি। নিজে তো বলেননি, অন্যদেরও বলতে দেননি। তিনি এমন একজন নেতা ছিলেন, যাঁকে খোদ জুলফিকার আলী ভুট্টোও ভয় পেতেন। তাজউদ্দীন সম্বন্ধে ভুট্টো একবার বলেছিলেন, ‘আমি তো শেখ মুজিবকে ভয় পাই না, আমি ভয় পাই তার পাশে বগলে ফাইল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ওই খাটো মানুষটিকে।’ প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কাছে ত্রাস ছিলেন তাজউদ্দীন।

তাজউদ্দীন আহমেদ নিজের ভালোমন্দ চিন্তা করতেন না। তিনি চাইতেন দেশ ও দেশের মানুষ ভালো থাকুক। নীরবে দেশের জন্য পরিশ্রম করে যেতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ক্যাম্পে গিয়ে বলেছিলেন, ‘মুছে যাক আমার নাম, তবু থাকুক বাংলাদেশ।’ হয়তো তিনি ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিলেন, তাই এমন কথা বলেছেন। বঙ্গতাজকে বাঙালির যেভাবে স্মরণ করার কথা আজ আমরা সেভাবে স্মরণ করতে পারি না। যে দেশ তৈরিতে অসামান্য অবদান তাঁর। যার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। তাঁকে কালেভদ্রে মনে করে এ জাতি। তবু খুব ছোট পরিসরে পালন করা হয় তাঁর জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকী। যেখানে অনেক দেশদ্রোহীকে উচ্চ স্থানে আসীন করেছে এ জাতি।

তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৪৬ সাল থেকে রাজনৈতিক সব আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের তিনি ছিলেন। ’৫২–এর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি স্বৈরাচারী আইয়ুব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন এবং কারারুদ্ধ হন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নেওয়া হয়, তখন পুরো দেশের ভার পড়ে এই নেতার ওপর। তিনি তাঁর প্রজ্ঞা, মেধা দিয়ে দেশকে ৯ মাসে শত্রুমুক্ত করেন। যুদ্ধের সময় তিনি ভারত সফরে গিয়েছিলেন। দেখা করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। সেখানে ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনের সঙ্গে দেখা হওয়ার শুরুতেই প্রশ্ন করেন, ‘মুজিব কেমন আছে? সে ঠিক আছে?’ জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, ‘২৫ মার্চের পরে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ হয়নি, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে এখানে পাঠিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়েছে। যেকোনো মূল্যে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। শরণার্থীদের জন্য প্রয়োজন আশ্রয় ও খাদ্য।’ এককথায় তাঁর ধ্যানজ্ঞান ছিল দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে।

এই ক্ষণজন্মা মানুষকে যদি বাংলাদেশ আরও কিছুদিন পেত, তাহলে এই দেশের চিত্র হয়তো ভিন্ন হতো। বাংলাদেশ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বঙ্গতাজের নাম। বাংলাদেশ ও তাজউদ্দীন একই সুতোয় গাঁথা। বাংলাদেশ যেন এখনো খুঁজে বেড়াচ্ছে তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তান তাঁর তাজ তাজউদ্দীন আহমেদকে।

প্রিয় নেতার জন্মদিনে রইল বিনম্র শ্রদ্ধা। আপনাকে নতুন প্রজন্ম সব সময় মনে রাখবে বাংলার তাজ হিসেবে। শুভ জন্মদিন হে নেতা...।

লেখক: শিক্ষার্থী, জার্নালিজম, কমিউনিকেশন অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিস বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ