সীমান্তে হাজার ওয়াটের বাতি ঝলমল করে

সীমান্তের কাঁটাতার–ঘেঁষা হাজার ওয়াটের বাতি দিনের আলোর মতো ঝলমল করে। ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম। ছবি: জোহা সুজন
সীমান্তের কাঁটাতার–ঘেঁষা হাজার ওয়াটের বাতি দিনের আলোর মতো ঝলমল করে। ভূরুঙ্গামারী, কুড়িগ্রাম। ছবি: জোহা সুজন

উত্তরের জনপদ কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী উপজেলায় আছে ভাসানী স্মৃতিপল্লি। সম্প্রতি বেশ কিছুদিন এখানে ছিলাম। এই পল্লির পূর্ব পাশে আসামের ধুবড়ী আর উত্তর-পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহার। সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত পল্লির পুব দিকে সীমান্তের কাঁটাতার–ঘেঁষা হাজার ওয়াটের বাতি দিনের আলোর মতো ঝলমল করে।

এই সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা সাগরের বর্ণনা মতে, এখানে নাকি রাতের আঁধার নামে না। তবে আমি কদিন এখানে থেকে লক্ষ করেছি, রাত ৮টা–৯টা বাজতেই সীমান্তের বাতিগুলো হঠাৎ নিভে যায়। ২০-৩০ মিনিট পরে আবার জ্বলে ওঠে। মাইলখানেক দূর থেকে আমি তা নিয়মিত দেখলাম।

বড় ভাই মনিরুজ্জামান খান ভাসানীকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, হয়তো গরু পারাপারের জন্য সময় দিয়েছে। শুনে প্রথমে থতমত খেলাম। ওপার থেকে দুধকুমার নদে গরু ভাসিয়ে দিয়ে কিছু লোককে নদের তীর ধরে দৌড়াতেও দেখলাম। অর্থাৎ, ‘ইধারকা মাল উধার, আর উধারকা মাল ইধার’ করা হচ্ছে।

মাঝখানে কাঁটাতার তথাকথিত সাবুদ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বড় বড় বাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র, সীমান্তে পাহারা, কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ—সব যেন অসাড় লাগছে। এসব দেখে আমার বঙ্গবন্ধুর ‘চোরের খনি’র কথাটা মনে পড়ে। ইদানীং উপমাটা সবখানেই বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে চোর দেখছি সবখানেই আছে। হোক সে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ কিংবা ছোট গণতন্ত্রের দেশ।

এখানকার গ্রামগুলো বিকেলবেলা প্রায় পুরুষশূন্য হয়ে যায়। গ্রামের ছেলে, বুড়ো সবাই কালাচাঁন মোড়ে আড্ডা জমায়। আগের মতোই টিভি চ্যানেলের কর্কশ আওয়াজ চায়ের কাপে তুফান তোলে ঠিকই। কিন্তু আলোচনার বিষয়বস্তু এখন আর রাজনীতি নয়, ভারতীয় গরু। আসন্ন ঈদ ঘিরে মনে হলো এখানকার রাস্তাঘাট, মোড়ে মোড়ে কাঁচা টাকা উড়ছে। সেই টাকা ধরতে এলাকার প্রভাবশালীরা রাত-দিন ফুসুর-ফাসুর ও দেনদরবার চালিয়ে যাচ্ছেন। টাকা ভাগাভাগি নিয়ে বাতচিৎ, কথা–কাটাকাটি, মারামারি হরহামেশাই হচ্ছে।

গরুর ব্যাপারীরা নাকি মাঝেমধ্যে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের ওপর চড়াও হন। আবার সমঝোতাও হয়ে যায়। তবে বিস্মিত হতে হলো স্কুল-কলেজপড়ুয়া ছাত্ররা কাঁচা টাকার নেশায় পথে পথে দালালদের পেছনে ঘুরছে দেখে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে শুনেছি, ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ রয়েছে। তারপরও স্থানীয় প্রশাসন, বিজিবি, পুলিশ ও সাংবাদিক সবার নাকের ডগা দিয়েই এসব ঘটছে।

ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে দুধকুমার তীরের শান্ত এই জনপদ একদা ঐশ্বর্যমণ্ডিত ছিল মানুষের সততা, সরলতা ও সুখী জীবনযাপনের জন্য। পলিমাটির মতোই এখনকার মানুষের মন ছিল কোমল। পরিশ্রম করে তারা জীবিকা নির্বাহ করত। একসময় উপার্জনের জন্য দূরে কাজ করতে গিয়ে যারা ‘মফিজ’ আখ্যা পেয়েছিল। চোখের সামনেই তাদের জীবনধারা বদলে যাচ্ছে। অনেকের জীবন-জীবিকা ভারতীয় গরু–নির্ভর হয়ে পড়ছে।

সমাজবিজ্ঞানীদের নজর ঢাকা থেকে চার শতাধিক কিলোমিটার দূরে সীমান্তঘেঁষা ভাসানী পল্লি ও আশপাশ এলাকার মানুষের দিকে আছে কি? এখানে তো লাইট, ক্যামেরা, অ্যাকশন, টক শো, মিডিয়ার ঝলকানি নেই। তাহলে কী আমাদের বিবেক, মৈত্রী, সভ্যতা কাঁটাতারের সংকীর্ণতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে? চোরাচালান, পুঁজি, লোভ এসব প্রাধান্য পাচ্ছে? আমাদের সমাজপতিরা এসব সাধারণ খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে? শুনতে পাওয়া যাচ্ছে দুধকুমারের চিৎকার? আকাশ বিদীর্ণ করে জানান দিচ্ছে শোষক আর চোরের কোনো জাত, ধর্ম, দেশ নেই।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ভাসানী পরিষদ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সন্তোষ, টাঙ্গাইল