করোনা ও আমাদের দিনলিপি

আমরা জাতিগতভাবেই আবেগী ও ডানপিটে স্বভাবের। এ ছাড়া অনেক সামাজিকও। সবাই মিলে দিন শুরু হয়, সবার সাথেই দিন শেষ হয়। আমাদের এই সামাজিক বন্ধনের কথা সবাই কমবেশি জানে। কিন্তু ২০২০ সাল আমাদের কাছে ‘অচেনা’ হয়ে আসে। এর মূলেই আছে বিশ্বজুড়ে চলা মহামারী করোনা।

করোনার কারণে আমাদের স্বভাব-বিরুদ্ধ শব্দের সাথে পরিচিত হতে হয়। যেমন ‘হোম কোয়ারেন্টিন’, ‘ফিজিক্যাল ডিস্টেন্স’ ইত্যাদি। হঠাৎ করেই বলা হলো অতিপ্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না, গৃহবন্দী থাকতে হচ্ছে, সামাজিক মেলামেশা বন্ধ, বন্ধ পাড়ায় আড্ডা, বন্ধুদের গল্প কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান। গৃহবন্দী হয়ে আমরা প্রতিদিন আক্রান্ত আর মৃত মানুষের হিসেব মিলাতে ব্যস্ত।

সমসাময়িক সংবাদে আমরা জানতে পারি, করোনা চটজলদি উধাও হয়ে যাবে না, কিংবা করোনার পরেও আমরা ঠিক আগের নিয়মে জীবনধারণ করতে পারব না, এক দীর্ঘমেয়াদী পরিবর্তন মেনে নিয়েই চলতে হবে। যেটাকে আমরা বলছি ‘New Normal’।

এখন অবশ্য বেশ কিছু মাস পেরিয়েছে। এই প্রায় গৃহবন্দী জীবন আর শারীরিক দূরত্বের কড়াকড়ির সাথে আমরা শাব্দিকভাবে পরিচিত হয়েছি। কিন্তু কতটুকু জীবনে মানিয়ে নিয়েছি সেটা একটা বড় ভাবনার বিষয়।

করোনা নিয়ে এখনও জনমনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রতিদিন গড়ে প্রায় আড়াই–তিন হাজারের বেশি করোনা আক্রান্তের খবরসহ অন্যান্য নেতিবাচক সংবাদে অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। এর সাথে আছে আর্থিক ও সামাজিক অবস্থানের এক মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।

একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, এই মুহূর্তে করোনার চটজলদি বিদায় হচ্ছে না, ভ্যাক্সিনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঘোষণা নেই, তাই বর্তমানে আমাদের হাতে ‘ঘরে থাকা’, ‘শারীরিক দুরত্ব’ রক্ষা করা ছাড়া অন্য উপায় নেই। কিন্তু যা আমাদের সংস্কৃতিতেই নেই, তা দু তিন মাসে রপ্ত করা কঠিন। তাই বাড়তে পারে পারিবারিক কলহ, মানসিক চাপের দরুণ অসুস্থতা, পারিবারিক সহিংসতা, পরিবার ভাঙন, আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি। সবগুলোর পরিণতি ভয়াবহ।

আমাদের অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে, দীর্ঘদিন ঘরে থাকার জন্য যাতে এসব সমস্যা সৃষ্টি না হয়। ঘরে থেকে আমরা যদি আমাদের সময় গুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে কলহ বা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত থাকতে পারব। এছাড়াও আমরা বর্তমান নতুন সময়কে নানান মজার মজার কাজে লাগাতে পারি। যেমন নতুন কিছু শেখা, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া, 'অনলাইন কমিউনিটি'র সাথে যুক্ত হওয়া, পরিবারকে সময় দেয়া ও অন্যান্য।

নতুন কিছু শেখা
আমরা ঘরে বসে নতুন কিছু শিখে নিতে পারি। এখন নানান অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম গুলো ফ্রিতে বা স্বল্পমূল্যে কোর্স করার সুযোগ দিচ্ছে। আমরা আমাদের পছন্দ মত বিষয়ে ঘরে বসেই জ্ঞানার্জন করতে পারি। দক্ষতা অর্জন করতে পারি, যা আনন্দের পাশাপাশি পরবর্তী কর্মজীবনেও কাজে আসতে পারে।

নতুন ভাষাও শিখে ফেলা যায় এই ফাঁকে। নতুন ভাষা জানলে আমরা নতুন বন্ধু বানাতে পারবো, সে দেশের সাহিত্য, দর্শন, জীবনধারণ তাদের ভাষাতেই জানতে পারব, কাজে আসবে আমাদের কর্ম জীবনে।

এছাড়া আমরা বই পড়ে সময় কাটাতে পারি। বই আমাদের সামনে নতুন পৃথিবী খুলে দেয়। বই আপনাকে এমন একটা জগতে নিয়ে যাবে যেখানে করোনা নেই, নেই কোন মহামারী, অসুস্থতা। আপনার সামনে এমন একটা বাস্তবতা উপস্থাপন করবে যেখানে থাকবে রোমাঞ্চ, ভালবাসা, আক্ষেপ, স্বপ্ন ইত্যাদি। আপনার সামনে একটা নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করবে বই! বই 'ভার্চুয়াল রিয়েলিটি'র মতই কাজ করে। বই আপনার বর্তমান দুঃসময় থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে। ফলে কমে যাবে 'ওভার থিংকিং' 'স্ট্রেস' 'ডিপ্রেশন'।

বই শুধু ভাল সময় কাটাতে সাহায্য করে এমন না, বরং আপনার জ্ঞান বাড়বে, বাড়বে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার দক্ষতা, বিশ্লেষণ ক্ষমতা ইত্যাদি। অর্থাৎ বই করোনায় মেন্টাল সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করে বাড়াবে ভবিষ্যৎ সফলতার সম্ভাবনা।

শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
বাসায় দীর্ঘ বসে শুয়ে থাকার কারণে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হতে পারে। প্রতিদিন নিয়ম করে সবাই মিলে ব্যায়াম করা যেতে পারে। ব্যায়ামের জন্যে জীমের ইন্সট্রুমেন্ট প্রয়োজন এমন নয়, বরং খুব সহজেই নানান "ফ্রি হ্যান্ড এক্টিভিটি" করতে পারি আমরা।

এছাড়া মেডিটেশন, ইয়োগাসহ মানসিক চাপ কমানোর নানান পদ্ধতি রয়েছে। কারণ একদিন করোনা অবশ্যই নির্মূল হবে, সে পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিকভাবে অবশ্যই সুস্থ থাকতে হবে।

অনলাইন কমিউনিটি
বর্তমান সময়ে ঘরে থাকা মানে চার দেয়ালে বন্দী এমন না, আবার শারীরিক দূরত্ব মানে যোগাযোগ বন্ধ এমনও না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা খুব সহজেই সবার কাছে থাকতে পারছি! আমরা কেউ ঢাকায় থাকলেও বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মানুষের সাথে নিমিষেই যুক্ত হতে পারছি, অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছি। আমাদের দেশের ইন্টারনেটের গতি যথেষ্ট উন্নত হয়েছে। ভিডিও কল এবং অনলাইন আড্ডা জনপ্রিয় হচ্ছে।

এছাড়া শুধু আড্ডা বা বিনোদনের জন্য নয়, অনলাইন কমিউনিটির মাধ্যমে আমরা নানান উন্নয়নমূলক কাজও করতে পারি, গড়ে তুলতে পারি ‘নেটওয়ার্ক হাব’, কেউ বিপদে পড়লে বা অসুস্থ হয়েছে জানালেই সবাই সাহায্য পৌঁছে দিবে ইত্যাদি।

পরিবারকে সময় দেওয়া ও অন্যান্য
জীবন দৌঁড় থেকে করোনা আমাদের একটা অনিচ্ছাকৃত বিরতি দিয়েছে! আর এই বিরতিকে আমরা পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে ব্যবহার করতে পারি। আমাদের বাসায় ঘরের বেশিরভাগ কাজ পরিবারের মেয়ে সদস্যরা করে। আমরা তাদের কাজে সাহায্য করতে পারি, সবাই মিলে ঘর পরিষ্কার করা, রান্নাবান্না ইত্যাদি করতে পারি। রাতে সবাই মিলে 'ইনডোর গেমস' খেলতে পারি, নাটক বা ছবি দেখতে পারি।

এছাড়া পরিবারের সবাই মিলে ধর্মীয় নিয়মকানুন চর্চা ও আলোচনা করতে পারি। নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা করতে পারি যাতে সবাই ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী জীবনযাপন করতে অনুপ্রাণিত ও সচেতন হয়।

ঘরে আমরা কেমন থাকবো সেটা আমাদের উপর নির্ভর করছে। আমরা চাইলেই ভাল থাকতে পারি, কিংবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে পারি। কিন্তু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে এমন মহামারী অনেকবার এসেছে, আবার বিদায়ও নিয়েছে। করোনাও একদিন বিদায় নিবে, সে পর্যন্ত আমাদের টিকে থাকতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে।