প্রিয় ক্যাম্পাসের প্রিয় মুখ

তখন ব্যস্ততার শেষ ছিল না আমাদের। রোজ ক্যাম্পাসে যেতাম। সবার সঙ্গে দেখা হতো প্রতিদিন। আমার বন্ধুদের সঙ্গে। কত কথা হতো। কত হাসি। কত কান্না। কত অভিমান। কিন্তু এখন কিছুই নেই। এখন আর অভিমান হয় না কারও ওপর। হয়তো ওদেরও হয় না। কারণ, আমরা সবাই বন্দী।

অদৃশ্য এক ভাইরাস আমাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বলেছে। কোয়ারেন্টিনের এই সময় অনেক মনে পড়ে তাদের। মনে পড়ে প্রিয় ক্যাম্পাসকে। প্রিয় হল, হলের বারান্দা, ছোট্ট দোকানদার সবুজ ভাই, মশাররফ ভাই—সবাইকেই মনে পড়ে। এখন সবাই নিজ বাসায় বন্দী সময় কাটাচ্ছেন।

নতুন বছরে চীনে যখন করোনার প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলছিল, আমরা তখনো জমিয়ে আড্ডা দিতাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ ঘাসে বসে বসে গল্প করতাম। সকালে হিমশীতল পরশে এক কাপ রং চায়ে চুমুক দিতাম কী সুখে! গাছে গাছে তখন সবুজের বিবর্ণতা। কিন্তু অনুষদের লিকলিকে চিকন আর লম্বা গাছের ডালে ঝুলে থাকা টিয়া পাখি সবুজের বর্ণ ফেরাত। আমি কেবল দেখতাম। কখন যে স্যারের ক্লাস শেষ হতো, টেরই পেতাম না। আমারও টিয়া পোষার শখ জাগত মনে। হলের বড় ভাইয়ের কাছে জানতে চাইলে জানালেন ভয়ের কথা। এভাবে পাখি ধরে খাঁচায় বন্দী করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। পুষতে চাইলে কিনে পুষতে হবে। তবু মন চাইত। কিন্তু মুক্ত আকাশের পাখি খাঁচায় যে শোভা পায় না, তার মানে কি আমার মন বুঝত?

জানুয়ারির শেষের দিকে আমাদের ট্যুর ছিল কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিনসহ আরও কয়েকটি উদ্ভিদসমৃদ্ধ অঞ্চলে। আমরা উদ্ভিদবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। প্রকৃতি নিয়েই আমাদের পাঠ। কিন্তু ট্যুরের আগের দিন রাতেই আমাদের একমাত্র পাহাড়ি বন্ধু উকিমনের মৃত্যু আমাদের বেশ নাড়া দিল। পুরো উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ শোকাহত। এই অনাকাঙ্ক্ষিত শোক বহন করে ট্যুরে যাওয়া সম্ভব না। আমরা ট্যুরে যাই ১২ ফেব্রুয়ারি। কত মজা করলাম! কত হইহুলোড়! সবকিছু ছুড়ে ফেলে সমুদ্রে নামলাম কত মমতায়। আমাদের পাশে কত মানুষ, কত আবেগ। দিগন্তের মেঘ জলরাশি ছুঁয়ে ফেলার সে কী মুগ্ধতা! আমরা ফ্রেমবন্দী হলাম নতুন ক্যামেরায় হাতে হাত ছুঁয়ে, পায়ে পা ছুঁয়ে। তখনো কি জানতাম সামনে আমাদের একা একাই বাঁচতে হবে? সবাইকে ছেড়ে একা থাকতে হবে?

ট্যুর থেকে ফিরে আসতেই পরীক্ষার ঘনঘটা। দ্রুতই পরিবর্তন আমাদের। পড়া আর পড়া। সবাই মিলে একসঙ্গে সাজেশন তৈরি। পাশাপাশি বসে কত নির্ঘুম রাত আমাদের। তখন কাগজের ওপর ভাইরাস ছিল না। চুমু খেতাম বইতে। এখন ভয় লাগে চুমু খেতে। বন্ধুদের সঙ্গে কত হেঁটেছি প্রিয় ক্যাম্পাসে। সবাই বলে দ্বিতীয় জন্মের আঁতুড়ঘর। আমি বলি প্রিয় মুখগুলোর স্মৃতির আঙিনা। সেখানে আমায় প্রিয় মানুষগুলো ছিল। আমিও ছিলাম। এখন কেউ নেই। সবুজ কানন আরও সবুজ হয়েছে। প্রকৃতি আবার ফিরে পেয়েছে বহুকালের পুরোনো শ্যামলতা। কিন্তু এত বেশি শ্যামলতা আমার প্রিয় না। মাঝেমধ্যে চোখ বন্ধ করে দেখি আবার আমাদের যান্ত্রিকতার আবহ। পুরোনো ক্লাসরুম, পুরোনো মানুষ আর আমার পুরোনো বন্ধুরা। প্রকৃতি হয়তো আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিচ্ছে। কিন্তু আমি একজনকেও হারাতে চাই না। পৃথিবী কি আমাদের আগের জায়গায় ফিরিয়ে দেবে? আগের মতো করে, আগের সবকিছুর কাছে?

*লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়