ফেস মাস্ক ব্যবহারে যোগাযোগমাধ্যমের পরিবর্তন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

ছোট একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করছি।

করোনাকালীন এ ভাইরাসটি থেকে বাঁচার জন্য দুটি বিষয়ের ওপর খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রথমত, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া এবং দ্বিতীয়ত, ফেস মাস্ক ব্যবহার করা। লকডাউন তুলে নেওয়ার পর থেকে যতবার প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাওয়া হয়েছে, আমি মাস্ক ব্যবহার করেছি। কিছুদিন ধরে লক্ষ করলাম, মাস্ক পরে কথা বলার সময় অনেকেই আমার কথা বুঝতে পারছেন না বা কথাটা আবার বলার জন্য অনুরোধ করছেন এবং আমারও মাস্ক পরা অনেকের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে এ সমস্যাটি হচ্ছে।

এর কারণ হিসেবে প্রথমেই যেটা আমার মাথায় এল, সেটা হচ্ছে মাস্কের কারণে কথা আস্তে শোনা যাওয়া। এরপর থেকে আমি জোরে বলা শুরু করলাম। সে ক্ষেত্রেও প্রথমেই আমার কথা বুঝতে অনেকের সমস্যা হচ্ছে দেখলাম এবং উপলব্ধি করলাম, সমস্যাটা হয়তো কথা আস্তে বা জোরে বলার কারণে হচ্ছে না। অন্য কোনো কারণে হচ্ছে। চলুন, জেনে নিই সেই কারণটি সম্পর্কে।

আমরা দৈনন্দিন জীবনে যোগাযোগের জন্য দুটি মাধ্যম ব্যবহার করে থাকি। সেগুলো হচ্ছে বাচনিক যোগাযোগ এবং অবাচনিক যোগাযোগ।

বাচনিক যোগাযোগ হচ্ছে ধ্বনি, শব্দ, বাক্য সামগ্রিকভাবে ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং অবাচনিক যোগাযোগ হচ্ছে মুখভঙ্গি, অঙ্গভঙ্গি, দৃষ্টি সংযোগ, পারস্পরিক দূরত্ব, লিখন ইত্যাদির মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ।

দৈনন্দিন জীবনে বাচনিক যোগাযোগটাকে আমরা লক্ষ করলেও অবাচনিক যোগাযোগটা তেমন লক্ষ করি না। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ যোগাযোগই আমরা করি অবাচনিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

আলবার্ট মেহরাবিয়ান নামে একজন গবেষকের মতে, মানুষের যোগাযোগের ৭ শতাংশ হয় বাচনিক যোগাযোগের মাধ্যমে, ৩৮ শতাংশ হয় কণ্ঠস্বরের ওঠানামা বা পরিবর্মের মাধ্যমে এবং বাকি ৫৫ শতাংশ হয় অবাচনিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময়ও কিন্তু সামনের মানুষটির ঠোঁটের নড়াচড়া, চোখের পরিবর্তন লক্ষ করেও আমরা তিনি কী বলছেন সেটা ধারণা করে নিই। মাস্ক পরে কথা বলার সময় আমাদের ঠোঁট দেখা যায় না। যে কারণে আমরা লিপ রিডিং করতে পারি না। আর এর প্রভাব পড়ে যোগাযোগে। প্রথমে আমি যে ঘটনাটি দিয়ে শুরু করেছিলাম, সে ক্ষেত্রে লিপ রিডিং অথবা ঠোঁটের নড়াচড়া লক্ষ করতে না পারার কারণেই সমস্যাটি হচ্ছে বলে আমার ধারণা।

এবার আসি আমাদের ইমোশন অথবা মানসিক অবস্থা প্রকাশ করার মাধ্যমে। আমাদের মানসিক অবস্থা কিন্তু অনেকটাই প্রকাশ পায় মুখভঙ্গির মাধ্যমে। যেটা অবাচনিক যোগাযোগের একটি অংশ। অনেক সময় পরিচিত কারও সঙ্গে দৃষ্টি সংযোগ হলেই আমরা হাসি। অথবা কারও কোনো প্রশ্নের জবাবেও অনেক সময় নিজের অজান্তেই আমরা হেসে উত্তর দিই। যেটা অন্যকে একটি পজিটিভ ধারণা দেয়। কিন্তু মাস্ক ব্যবহারে এটাও এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। দেখা গেল আপনি খুশি হয়ে হেসে কোনো একটা কথা বললেন, কিন্তু আপনার কমিউনিকেশন পার্টনার হাসিটা না দেখার কারণে বুঝতেই পারল না যে আসলে আপনি আনন্দিত কি না। তাই বাচনিক যোগাযোগটাই এখম ব্যবহার করতে হচ্ছে বেশি।

যাদের ভাষাগত নানা সমস্যা রয়েছে, এর প্রভাব তাদের ওপর আরও বেশি। একজন শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধিতায় ভোগা মানুষ কিন্তু অবাচনিক মাধ্যমের ওপরেই নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে মুখভঙ্গি না দেখতে পারা তাদের যোগাযোগমাধ্যমে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।

তাহলে একটি প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে যে এ ক্ষেত্রে কী করা যেতে পারে? ফেস মাস্কের পরিবর্তে ফেস শিল্ডের ব্যবহার এ ক্ষেত্রে হয়তো কিছুটা হলেও সাহায্য করতে পারে।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় অবশ্যই আমাদের মাস্ক ব্যবহার করতে হবে এবং এ জন্যই আমাদের যোগাযোগে কিছু পরিবর্তন আমরা আনতে পারব। বাংলা শব্দভান্ডার অনেক সমৃদ্ধ। কিন্তু ব্যবহারের অভাবে অনেক শব্দই হারিয়ে ফেলছি আমরা। এ সুযোগে আমরা বেশি বেশি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতে পারি। ইংরেজি অনেক ফিলিংস ওয়ার্ড কিন্তু আমরা ব্যবহার করতে দেখি। যেমন: I'm happy/ sad/ bored. সেভাবে বাংলা ভাষায়ও আমরা ‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নটির জবাবে শুধু না হেসে বলতে পারি, ‘আমি ভালো আছি/ আমি ভালো নেই/আমি খুবই বিরক্ত এখন। যেটা আমাদের ভাষার ক্ষেত্রে একটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

এবার আসি অবাচনিক মাধ্যমে। আমরা সবাই কিছু বেসিক সাইন ল্যাংগুয়েজ শিখে নিতে পারি এখন। ইউটিউবেই আমরা এগুলো পেয়ে যাব। এর মাধ্যকে আমরা মাস্ক পরেও একজন বাক্‌ ও শ্রবণ সমস্যায় আক্রান্ত মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।

এভাবে একটু চেষ্টা করলেই আমরা খুব সহজেই মাস্ক ব্যবহার করেও কোনো সমস্যা ছাড়াই অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব বলে আমি মনে করি।

*লেখক: শিক্ষার্থী, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়