ফেসবুক রি-অ্যাক্ট: মেধা যাচাইয়ের মানদণ্ড

ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।

একটি পরিবেশবিষয়ক প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতা হবে। সেই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নানান নিয়ম জুড়ে দিলেন আয়োজকেরা। তার মধ্যে সবচেয়ে নজরকাড়া নিয়মটি হচ্ছে, প্রতিযোগিতার বিচারকাজ সরাসরি কোনো মানুষ করবে না। ফেসবুকের লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের মাধ্যমে এগিয়ে থাকা প্রতিযোগীকেই বিজয়ী ঘোষণা করা হবে।

যে প্রতিযোগিতার কথা দিয়ে এই লেখা শুরু করলাম, সেটি লেখকের কল্পনাপ্রসূত হলেও একেবারে অবাস্তব নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমনই অসুস্থ প্রতিযোগিতার দেখা মিলছে হরহামেশাই। ফেসবুকের তথাকথিত রি-অ্যাকশন হয়ে যাচ্ছে মেধা যাচাইয়ের মানদণ্ড!

মেধা কী? সহজ করে যদি বলি, মেধা হচ্ছে ‘প্রশংসনীয় গুণ বা যোগ্যতা’। এই দিক বিবেচনায় আমাদের সবারই কিছু না কিছু প্রশংসনীয় গুণ আছে। সেই গুণের বিকাশ ঘটাতে পারার মধ্যেই মেধার মূল্যায়নের ব্যাপারটি সামনে আসে। প্রশংসনীয় গুণগুলো কী হতে পারে? কেউ হয়তো কবিতা লিখতে পারেন, পারেন কণ্ঠের জাদুতে সবাইকে মোহিত করতে কিংবা কারও হয়তো ছবি তোলার শখ আছে। এসবই তো মেধা।

দীর্ঘদিন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওর উপাচার্য ও প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বাংলাদেশের রাঙামাটিতে জন্ম নেওয়া অমিত চাকমা। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের সবার মস্তিষ্কের অনেক কিছু শেখার, জানার এবং করার ক্ষমতা আছে। মস্তিষ্ককে প্রশিক্ষণ দিয়েই মেধার বিকাশ করতে হবে। সে জন্য প্রয়োজন চেষ্টা। চেষ্টা না থাকলে মেধা অর্থহীন।’

প্রশ্ন হচ্ছে, মেধার বিকাশ যদি করা যায়, সে ক্ষেত্রে সেই মেধার মূল্যায়ন করবে কারা? আমরা স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নানান বিষয় নিয়েই তো পড়াশোনা করছি। কখনো কি দেখেছেন গণিতের শিক্ষককে বাংলা পড়াতে বা অঙ্কনের শিক্ষককে রসায়ন ল্যাবে ছাত্রদের এক্সপেরিমেন্ট করাতে? যেই শিক্ষক যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, তিনি তো সেই বিষয়েই পড়ান। মেধার মূল্যায়নের ক্ষেত্রটাও ঠিক একই। আপনি যে বিষয়ে পারদর্শী বা আপনার শখের জায়গাজুড়ে যে বিষয়টি, সেটির মূল্যায়ন একমাত্র তাঁরাই করতে পারবেন, যাঁদের আপনার বিষয়টিতে অভিজ্ঞতা বহুদিনের। সাধারণত কোনো একটি প্রতিযোগিতায় যেসব বিচারক দায়িত্ব পালন করেন তাঁরা অবশ্যই প্রতিযোগিতার বিষয়টিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা নিয়েই বিচারকের আসনে বসেন। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েই বিচারকেরা বিজয়ীকে নির্ধারণ করে থাকেন। এমনটাই কি হওয়া উচিত নয়?

কিন্তু ফেসবুককেন্দ্রিক প্রতিযোগিতাগুলোয় কী হচ্ছে? এই লেখার শুরুতেই যে প্রতিযোগিতা নিয়ে বলছিলাম সেটিতে আরেকবার ফেরত যেতে চাই। ধরুন, একজনের নাম দিলাম আকাশ, সে অনেক তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে রীতিমতো পরিশ্রম করে পরিবেশ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে পাঠাল। আরেকজন, ধরুন নাম দিলাম বাতাস। সে করল কি গুগলের সহযোগিতা নিয়ে কয়েকটা লেখাকে জোড়াতালি দিয়ে প্রবন্ধ বানিয়ে পাঠিয়ে দিল। যেহেতু এই প্রতিযোগিতায় কোনো বিচারক নেই, সেহেতু প্রবন্ধগুলোর স্বকীয়তা বা ন্যূনতম মান নিয়েও ভাবার অবকাশ থাকছে না। বিচারের মানদণ্ড হয়ে যাচ্ছে লাইক, কমেন্ট, শেয়ারের মতো যান্ত্রিক বাটনগুলো।

ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।
ছবিগুলো ইন্টারনেট থেকে পাওয়া।

ফেসবুক রি-অ্যাক্টও কি পারছে মেধার সঠিক মূল্যায়ন করতে? দুটো বিষয় এ ক্ষেত্রে সামনে চলে আসে। প্রথমত, এই পদ্ধতিতে রি-অ্যাক্ট প্রদানকারী সবাই বিচারক। কিন্তু সবাই কি ঠিক বিচারটা করতে পারেন? উত্তরটা সহজ। প্রতিযোগী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশির ভাগ রি-অ্যাক্ট প্রদানকারীই লেখা না পড়েই রি-অ্যাক্ট দিয়ে দায় সারেন। মেধার মূল্যায়ন এভাবেই অবমূল্যায়িত হচ্ছে! দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতার নিয়মটা এমন যে, যাঁর লেখা সংবলিত পোস্টে সর্বোচ্চ লাইক, কমেন্ট, শেয়ার থাকবে, তিনিই হবেন বিজয়ী। প্রশ্ন থাকে, সব প্রতিযোগীর কি একই সংখ্যক বন্ধু থাকেন? যদি না থেকে থাকে তাহলে সবাই তো সমান সুযোগ পাচ্ছেন না। যাঁর ফেসবুকে চেনা-পরিচিত বেশি বা ফেসবুকে যাঁর বন্ধু তালিকাটা বেশ দীর্ঘ, তিনিই তো বেশি সুবিধাটা পেয়ে যাচ্ছেন। অন্য একজনের লেখার মান ভালো হলেও স্রেফ চেনা-পরিচিত কম থাকার কারণে রি-অ্যাক্ট কম পাওয়ার জেরে তাঁকে হার মেনে নিতে হচ্ছে। কী এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা!

মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছেন এমন এক পরিচিত বন্ধুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল মেধার এই অবমূল্যায়নের দীর্ঘ প্রভাব নিয়ে। তিনি এক আশঙ্কার কথাই জানালেন। প্রতিযোগিতায় এমন কেউ যদি বিজয়ী হয়ে যান যিনি কিনা লেখার ক্ষেত্রে নিজের মেধাকে কাজে না লাগিয়ে গুগলের মেধা কাজে লাগিয়েছেন বা অন্ধ রি-অ্যাক্টের জোরে প্রথম স্থানটা বাগিয়ে নিয়েছেন, তিনি বিজয়ী হয়ে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবেন। এমন করেই আগামীর পথগুলোতেও চেষ্টা করবেন তিনি, হয়তো আবার সফল হবেনও। কিন্তু যে প্রতিযোগী মেধা খাটিয়ে চেষ্টার সর্বোচ্চটা দিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিলেন, তিনি যখন বিচারকার্য পদ্ধতির গলদের কারণে নিজেকে অবমূল্যায়িত হতে দেখেন, তাঁর ক্ষেত্রে তো ঠিক উল্টোটি ঘটবে। তিনি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন তাঁর দক্ষতার জায়গাটিতে। এমন করে সামাজিক ভারসাম্যহীনতার আশঙ্কা জন্মাবে। সস্তা জনপ্রিয়তার এই খেলায় মানসিক স্বাস্থ্যেও ফেলতে পারে নেতিবাচক প্রভাব।

আয়োজকেরা কেন করছেন এমন অবমূল্যায়নের প্রতিযোগিতা? এর পেছনে প্রধান কারণই ব্যবসায়িক স্বার্থ। প্রতিযোগিতাগুলো একটি ফেসবুক গ্রুপ বা পেজে হয়ে থাকে। আয়োজকদের রি-অ্যাক্ট সংশ্লিষ্ট শর্ত দেওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে তাদের গ্রুপ বা পেজের প্রচার বাড়ানো। কিন্তু প্রচার বাড়াতে গিয়ে মেধার এমন অবমূল্যায়ন ঘটিয়ে পরোক্ষভাবে সমাজের ক্ষতিটাই কি করছেন না তারা?

লেখক: লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]