অবশেষে জেনেছি মানুষ একা...

কবি আবুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত
কবি আবুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত

‘হে প্রেম গোলাপ আর পাখির কাকলি
তোমার গন্ধ নিয়ে আজও বেঁচে আছি—
আজও ওই সুনীল আকাশে রাখি,
সব ক্লান্ত জীবনের কথা?’

৬০ দশকের কবি আবুল হাসান আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশে ক্ষণজন্মা গুটিকয়েক নক্ষত্রের মতো অন্যতম একজন প্রধান কবি হিসেবে পরিচিত। মাত্র ২৯ বছরের অনেকটা নিঃসঙ্গ কাব্যময় জীবনের তিনি যেমন একদিকে আধুনিক বাংলা কবিতাকে করেছেন আরও আলোকিত, একাধারে পাঠকের হৃদয়ের মণিকোঠায় মর মর জাগিয়ে আজন্ম স্থান দখল করে নিয়েছেন অল্প সময়ের মধ্যেই। জীবদ্দশার ১০ বছর ধরে লিখেছেন তিনটি বইসহ বেশ কিছু অপ্রকাশিত কবিতা। আজন্মই অনেকটা বোহিমিয়ান স্বভাবের কবি আবুল হাসান, যাঁকে স্কুল–কলেজের নিয়মতান্ত্রিক প্রথা কখনোই বাঁধতে পারেনি কোনোকালেই। যিনি নিজেকে আপাদমস্তক উপসর্গ করেছেন কবিতার কাছে, শহরজীবন, বন্ধু আড্ডা পাখির শিস, সবুজ আকাশ আর ভেঙে পড়া রাতের তাবৎ ক্লেদাক্ততায় সুপ্ত শিশির বিম্বের মতোই মোহ নিয়ে খুঁজেছেন কবিতার নিবিড় স্পর্শ। প্রকৃতির রূপ–লাবণ্যে কবি পেয়েছেন বিদায়ের শেষ সন্ধিক্ষণে অস্ত যাওয়া সোনালি দিগন্তে চোখ ফেলে রাখা এক জোড়া সারসের ডানা জাপটে উড়ে যাওয়া আর্তনাদ। কবি আবুল হাসানের কবিতায় অতি নীবরভাবে ফুটে তার চারপাশের চলমান জীবন বা¯তবতার শাণিত রূপ, আবহমান গ্রামবাংলার সবুজ প্রকৃতির মাধুরী। জ্যোৎস্নায় কচি ধান শিষের চিবুকে লেগে থাকা ফসলের নব্য দুধেল ঘ্রাণ—

‘কবে কখন মায়ের চোখে নিজের মুখের আদল দেখে, প্রিয়ার বুকের ননি ছেড়ে আলোর মতন ভালোবাসায়, ধানের কচি সবুজ ডগায়, মেঠো পথের করুণ ধুলোয় মুখর নদীর স্রোতোধারায় বনের মতন গভীর বুকে, কিংবা কোনো ক্লান্ত চোখে পালক জাগার প্রথম চাঁদে, নিজেই কখন ব্যর্থতাকে বাঁশির সুরে সঁপে দিলুম!’

নদীর চকচকে জলে গুংড়ে কাদা ঝিনুকের জঠরবেদনা, অন্তঃক্ষরণ, আবুল হাসান যার সঙ্গে অতি সূক্ষ্ম মেলবন্ধন ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর কলমের কালিতে বারবার বেজে উঠেছে কাদা-বালি জলে মিশে থাকা বিষের ভায়োলিন যার বিরহী সুর ডেকে আনে কেবল হাহাকার:

‘ঝিনুক নীরবে সহো
ঝিনুক নীরবে সহো, ঝিনুক নীরবে সহে যাও—
ভেতরে বিষের বালি; মুখ বুঝে মুক্তা ফলাও!’

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের পর কবি আবুল হাসানের মতো বাংলার মধুর রূপ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে খুব কম কবি–লেখকদের লেখনীতেই খুঁজে পাওয়া যায়। চাবুকে দাবড়ানো ফেলে আসা শৈশবকে ডিঙিয়ে কৈশোরকে বরাবর তাঁর কবিতায় বয়ে নিয়ে গেছেন কবি। ব্যক্তিজীবনে অতি কাছের কিছু বন্ধু, মধ্য রাত অব্দি আড্ডা দেওয়া, কাউকে কিছু না বলে হুটহাট উধাও হয়ে যাওয়া সবার অগোচরে স্টেশন থেকে স্টেশনের সাইরেনে পুনশ্চ ফিরে আসা—তার কোনো কাব্য নিয়ে কিংবা ক্রমাগত জীবনের নানা ঘাত–প্রতিঘাতে তুলে এনেছেন মুক্তিসংগ্রামের ইতিকথা, ব্যক্তিচিন্তাধারা, রাজনীতি সমাজ বাস্তবতার অতি সূক্ষ্ম বিশেষণে কবি লিখেছেন—

‘মৃত্যু আমাকে নেবে
জাতিসংঘ আমাকে নেবে না।
মানুষ চাঁদে গেল, আমি ভালোবাসা পেলুম;
পৃথিবীতে তবু হানাহানি থামল না...’

কবি বারবার প্রেমে পড়ছেন, আঘাত পেয়েছেন তবু আবার প্রেমে পড়েছেন। আবুল হাসানের কবিতাজুড়ে থাকে বিস্তর এক বেদনাকাতর প্রেম, যার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়া শরীর বেয়ে ঝরে পড়া নোনা রক্তের স্রোতোধারা, যার কান্নার রোল তার অগণিত পাঠক হৃদয় আজও আপন আরশিতে বয়ে বেড়ায় নিয়তই। তাই কবি লিখেছেন—

‘আমার হবে না আমি বুঝে গেছি আমার সত্য মূর্খ,
আকাট! ফুল আমি যত বাগানের মোড়ে লিখে যাই,
দেখি আমার খুলে পড়ে যায় বিষ পিঁপড়ে, বিষের পুতুল!’

আবুল হাসানের কবিতা মানেই এক উন্মাদনা, অপেক্ষার প্রহর ফোরালেও থেকে যায় তার আকণ্ঠ; যে আকণ্ঠ কলিকুল প্রস্ফুটিত হওয়ার প্রাক্কালের, যে আকণ্ঠ এক বর্ষা বৃষ্টির জন্য, চৈত্রের পুড়ে যাওয়ার খরস্রোতা তৃষিত নদীর হয়তো যে আকণ্ঠ রেখেছেন তিনি একটি বালিকার জন্য—

‘অতটুকু চায়নি বালিকা!
অত হৈ রৈ লোক, অত ভিড়, অত সমাগম!
চেয়েছিল আরও কিছু কম—
একটি জলের খনি
তাকে দিক তৃষ্ণা এখনই,
চেয়েছিল একটি পুরুষ তাকে বলুক রমণী!’

এভাবেই কবি জীবনকে খুঁড়ে গেছেন অতল থেকে অতলে আর জীবনের পাওয়া না–পাওয়ার অন্তিম আচ্ছাদনের শেষ হিসেবে কবি লিখেছেন:

‘অবশেষে জেনেছি মানুষ একা
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা!’

আজ বাংলা সাহিত্যের ক্ষণজন্মা ক্লেদাক্ত কুসুমের কবি আবুল হাসানের জন্মদিবস; মাত্র ১০ বছর তাঁর কাব্যজীবন। ২৯ বছর তাঁর জীবনকাল। ১৯৪৭ সালের ৪ আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর। বাংলাদেশের একজন আধুনিক কবি, যিনি ষাটের দশকের সঙ্গে চিহ্নিত। পেশায় তিনি সাংবাদিক ছিলেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবুল হোসেন মিয়া আর সাহিত্যিক নাম আবুল হাসান। তিনি ষাটের দশকের জনপ্রিয় কবিদের একজন এবং সত্তরের দশকেও গীতল কবিতার জন্য জনপ্রিয়তা পেয়ে যান। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যের এই অমর কবি।

কবি–আত্মার প্রতি রইল সহস্র বিনম্র শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। আজ কবির ভাষায় আমরাও বলতে চাই—

‘কী করে জাগাব তাকে?
ঈশ্বর বড় অকরুণ...’