১০১ একরে আমাদের দিনগুলো

ভোরের আলোয় আলোকিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীদের পদচারণে প্রাণবন্ত হয়ে উঠে ক্যাম্পাস। মনে হয় এ যেন এক জ্ঞান পিপাসুদের মিলনমেলা। পরিবারের আপনজন ছেড়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে যেন এক স্বপ্নভূমি। বলছিলাম নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (নোবিপ্রবি) কথা।

১০১ একরের এই ক্যাম্পাসে ভর্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে ভর্তি হই অণুজীববিজ্ঞান বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৩ তম ব্যাচ ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের ৯ম ব্যাচ হিসেবে পথচলা শুরু হয় আমাদের। ভর্তির পর আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। দিনটা ছিল ২০১৮ সালের ৩ জানুয়ারি। আমাদের নবীনবরণ ঘিরে নতুনভাবে সাজানো হয় অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ। একাডেমিক ভবন ১ এর ৫ তলার এই বিভাগে আমাদের পদচারণায় প্রতিনিয়ত মুখরিত থাকত। সময়ের ব্যবধানে ১০১ একরের ক্যাম্পাস ও প্রিয় বিভাগ ঘিরে জমা হয়েছে অনেক স্মৃতি।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে নতুন পরিচিতি হয়। দেশের ভিন্ন জায়গা থেকে আগত ভিন্ন মানসিকতা, ভিন্ন সংস্কৃতি, ভিন্ন ধর্মের মানুষগুলো হয়ে ওঠে এক আত্মার একই প্রাণ। আনন্দ, খুশি, বেদনা, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দিনগুলো কাটতে থাকে। ভালোবাসার ক্যাম্পাসের ব্যস্ত দিনগুলোর স্মৃতি আজও অমলিন ও মধুর বটে। ক্যাম্পাসের দিনগুলোর কথা মনে করলে ব্যস্ত দিনগুলোর কথা মনের আয়নায় ভেসে ওঠে। কতই না মধুর ছিল সেই সময়টা।

ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট, ল্যাব ওয়ার্কের মধ্য দিয়ে ব্যস্ত সময় কাটছিল । সকালে ক্লাস করার জন্য সাদা বাস, লাল বাসে করে ক্যাম্পাসে যাওয়া আবার ক্লাস শেষে এই লাল বাস, সাদা বাসে করে ঘরে ফেরার তাড়া থাকত। আমাদের মাঝে চলতো ক্লাস টেস্ট, সেমিস্টারে ভালো করার প্রতিযোগিতা। প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট এবং ল্যাব ক্লাসের ল্যাব এক্সপেরিমেন্টে ভালো করার প্রতিযোগিতা চলতো।

আমাদের আনাগোনায় ব্যস্ত থাকত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মালেক উকিল হল, বিবি খাদিজা হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলগুলো। ক্যাম্পাসের ব্যস্ত দিনের অনেকটা সময় কাটতো খেলার মাঠে। আন্ত:বিভাগ, আন্ত:বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট টুর্নামেন্ট, ফুটবল টুর্নামেন্ট, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট, দাবা টুর্নামেন্ট, ভলিবল টুর্নামেন্টে থাকত সেরা হওয়ার প্রতিযোগিতা।

আয়তন ছোট হলেও এখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কমতি নেই। গ্রীষ্মের আগমনে কালো মেঘে ছেয়ে যায় পুরো ক্যাম্পাস, শুরু হয় কালবৈশাখী ঝড়, প্রকৃতি হয়ে উঠে রুক্ষ। আবার বর্ষার আগমনে প্রকৃতি হয়ে উঠে সতেজ। শরতের কাশফুল যেন হেমন্তে এসেও তার ভালোবাসার জানান দেয়, বাতাসে দোলানো কাশফুল দেখলে মনে হয় এ যেন সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। এ ছাড়া সূর্যমুখী ফুলের আগমনেও নোবিপ্রবি পায় নতুন সাঁজ।

শীতের সময় অতিথি পাখির আগমন ক্যাম্পাসকে আরও পরিপূর্ণ করে তোলে। বিবি খাদিজা হল সংলগ্ন লেকে এবং সেন্ট্রাল লাইব্রেরি সংলগ্ন পুকুরে চোখে পরে অতিথি পাখির কিচিরমিচির কলতান। ক্লাসের ফাঁকে কিংবা অবসরে টংয়ের দোকানে আড্ডা দেওয়া, বাংলাবাজারে ঘুরতে যাওয়া, গোলচত্বর, প্রশান্তি পার্ক, শান্তিনিকেতন, নীল দিঘির পাড়ে চড়ুইভাতি, জন্মদিন পালন, বারবিকিউ পার্টি, ট্যুর দেওয়া এভাবেই কাটছিল দিনগুলো।

কোভিড-১৯ এর কারণে সেই ব্যস্ত দিনগুলোর সমাপ্তি ঘটে। বন্ধ ঘোষণা করা হয় ক্যাম্পাস। চার মাসের বেশি সময় যাবৎ ক্যাম্পাস থেকে দূরে। ব্যস্ত ক্যাম্পাস আজ ফাঁকা পড়ে আছে বিষণ্নতায় আর শূন্যতায় ঘরবন্দী করেছে আমাদের। ব্যস্ততায় ভরপুর জীবন আজ নিষ্প্রাণ। অফুরন্ত অবসর, তবুও কারও মনে নেই আনন্দ। চেনা ক্যাম্পাস যে অচেনা হয়ে উঠবে, প্রিয় ক্যাম্পাস ছেড়ে বন্দিজীবন কাটাতে হবে কেউ কল্পনাও করে নিঃসরণ।

ব্যস্ত ক্যাম্পাসের কোথাও কারও কোনো ব্যস্ততা নেই। অডিটোরিয়াম ভবন, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, গোলচত্বর, নীলদীঘি, প্রশান্তি পার্ক ক্যানটিন, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া, শান্তিনিকেতনের পাশের টং দোকানগুলো আজ জনশূন্য। লাল বাস, সাদা বাসগুলোতে সিট ধরার জন্য কোনো দৌড়ঝাঁপ নেই। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপের চুমুকে গিটারের টুংটাং ধ্বনিতে মুখরিত জায়গাগুলো আজ হাহাকার করছে।

প্রাণের ক্যাম্পাসকে অনেক মিস করছি। মিস করছি ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখগুলোকে। মিস করছি প্রিয় অণুজীববিজ্ঞান বিভাগকে, যেই বিভাগে জমা আছে শত স্মৃতি। মিস করি আবদুল মালেক উকিল হলের ৪০৪-এ কাটানো দিনগুলো। জানি না কবে শেষ হবে এই যুদ্ধ আর কবে ফিরে যাব ক্যাম্পাসে, আবার প্রাণ ফিরে পাবে প্রিয় ক্যাম্পাস। ভালো থাকুক সকলে, সুস্থভাবে ফিরে আসুক ক্যাম্পাসে এটাই প্রত্যাশা।

*লেখক: শিক্ষার্থী, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়